আমাদের গ্রামের পাশ্বর্বতী গ্রাম ছুইদানা। ঐ গ্রামে বসবাস করতেন নিম্ম মধ্যবিত্ত সনাতন ধর্মের গোটা পাঁচেক পরিবার। এদের মধ্যে মধ্যবিত্ত একজন আমাদের নিবারণ কাকা। নিবারণ কাকা ছিলেন ন্যায় নীতির একজন ধারক ও বাহক। তার দুই ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট মেয়ে ছিলেন সাক্ষাত দেবী লক্ষি। নাম তার সূচনা হালদার। যেমন তার চেহারা তেমন তার চালচলন আর বাচনভঙ্গি। কিন্তু সৌন্দর্যের অহংকারে গদগদ সূচনা হালদার। পা মাটিতে পড়তে কস্ট হতো তার। কিন্তু তৎসময় মাটি ছাড়া উপায় কি ? গাড়ী বলতে গরুর গাড়ী ছিলো জনমানুষের চলাচলের যোগাযোগ মাধ্যম। সূচনাদের নিজের বলতে বাড়ি ভিটে আর কাটা বিশেক চাষের জমি। অত:পর পা মাটিতে না ফেলে উপায় নেই। বলছি, প্রায় তেত্রিশ বছর আগের কথা। শোনেছি, নিবারণ কাকার স্ত্রী আর দুই ছেলে পরলোকগত, বড় মেয়ে অহনা হালদার ভারতবাসী । বর্তমানে সূচনা হালদার স্বামী হারা বিধবা। সংসারে প্রবেশের আগেই বিয়ের পনের দিনের মাথায় সূচনার স্বামী দীনেশ শহর থেকে মোটরবাইকে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দূর্ঘটনায় পরলোগত হন। তারপর থেকে সূচনা হালদার বাপের বাড়িতেই অবস্থান । সে যাই হোক, আমি আমার মধ্যবিত্ত পিতা নবারুন মিত্রের একমাত্র সন্তান। ক্লাস এইটে পড়ি গ্রামের সেরা সুন্দরী মেয়েটার পিছনে ৩ বছর ঘুরলাম। তাকে ভালোবাসবো বলে।
–কিন্তু তাকে কখনো বলা হয়ে উঠেনি ‘সূচনা’ আমি তোমাকে ভালোবাসি। সাহস পাইনি, মেয়েটা খুব রাগি আর আত্ব-অহংকারী বটে। যদি বাবাকে বা গ্রামের কাউকে বলে দেয়। তবে পরিবারের মান সন্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে শতভাগ। আর আমাকে ছাড়তে হবে ঘর-বাড়ি।
সেই ভয়ে গত প্রায় তিন চার বছর আমি আর সূচনার পিছু নেই না। কারন : যাকে পাওয়ার আশা নেই তার পিছনে ঘুরে কি লাভ। তাছাড়া লোকমুখে জানতে পারি, নিবারণ কাকাসহ স্ব-পরিবারে ভারতের আসামে চলে যাবে, বাড়ি জমি বিক্রির চেস্টা চলছে। সূচনাকে সেখানে নিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দেবে।
ইতিমধ্যে দেশে ভয়াবহ বন্যার করালশ্রোতে আমার পরিবারে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। বাবা অস্থির হয়ে পড়েন। মানুষের ঋনের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়লেন বাবা, জায়গা জমি বাড়ি ভিটে বিক্রি করে পাওনাদারদের ঋণ পরিশোধ করে আমাকে আর মাকে নিয়ে পাড়ি জমালেন ভারতের আসাম রাজ্যের কোন এক অজপাড়া গায়ে। সেখানেও কস্টের শেষ নেই, কাজ করলে খাবার জোটে নইলে উপোষ। এভাবে কেটে যায় আরো তিন বছর। তারপর, আবারো সেই জন্মভূমি। দেশে ফিরে এক টুকরো জমির উপর খড়-কুটোর বাড়ি তৈরি করে আমাদের বসবাস। হাটে বাজারে ঘুরে মসলার ব্যবসায় যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালান বৃদ্ধ বাবা নবারুণ। আর মা গৃহিনী, বাবার একা আয়-রোজগারে সংসার চলে গরুর গাড়ীর মতো। তাই আমার লেখাপড়ায় ভাটা পড়ে। ততাপি চলছে আমাদের জীবন।
আর ওদিকে নিবারণ কাকা এই তিন চার বছরে আঙুল ফোলে কলাগাছ। তিনি স্থানীয় এক চেয়ারম্যানের হাত ধরে দালালী করে বেশ টাকা কড়ির মালিক বনে গেছেন। কিন্তু মনে শান্তি নেই, স্ত্রী পাগল প্রায়, বড় ছেলে গাঁজাখোর তার উপর চেনা জানাহীন কোথা থেকে এক মেয়ে বিয়ে করে অন্যত্র বাসা বেঁধেছে। ছোট ছেলে বখাটে, তৃতীয় কন্যা অহনা হালদার পাড়ার এক বখাটে ছেলের হাত ধরে উধাও। চতুর্থ অর্থাৎ ছোট মেয়ে সূচনা হালদার লেখা পড়ায় ব্যস্ত। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ভাববার সময় নেই তার।
তারপর,
একদিন চৈত্রের প্রচন্ড তাপদাহ শেষে পড়ন্ত বিকেলে পাড়ার খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দেয়ার সময় হঠাৎ সূচনা হালদার এসে বলতে লাগলো।
–সৈকত, তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। একটু সময় দেবে
আমায় ?
–কেনো নয়, কিন্তু কথা কি এখানে বলা যায় না ?
–না, তোমার বন্ধুদের সামনে বলা যায় না। উঠে এসো।
–অবাধ্যতার বেঁড়েজাল ছিঁন্ন করে, নম্র ভদ্র ছেলের মতো সৈকত
উঠে দাঁড়ালো এবার।
–সূচনা : চলো ।
–সৈকত : হ্যাঁ চলেন ?
কিছুদূর যাওয়ার পর সৈকত জিজ্ঞেস করলো, কি বলবেন বলুন ?
–নিশ্চয়ই বলবো, সামনে চলো। ইদানীং তুমি বুঝি খুব ভদ্র হয়ে
গেছো ?
–কেনো ? আমি কি খুব খারাপ ছেলে আপনার কাছে ?
–না, তা নয়, তবে–
–তবে কি, বলুন ?
–ইদানীং কি নতুন কোন মেয়ের হাত ধরেছো নাকি ?
–নতুন মেয়ে মানে। পুরাতন কেউ ছিলো কি আমার জীবনে ?
–কাহিনী কি বুঝলাম না। এতো পরিবর্তন তোমার ?
–তেমনটা না। আমি যেমন ছিলাম তেমনি আছি।
–তাহলে ?
–তাহলে কি ?
–তুমি কি কাউকে ভালো বাসো না ?
–ভালোবাসা, আমরা দরিদ্র, তাই হয়ত, সাহস হয়ে উঠে না
–তারপর ?
–আপনার বাবা বিত্তবান, আপনি বিত্তবানের মেয়ে আর আমি।
–তুমি কি ?
–আমার পিতা দরিদ্র পিতার দরিদ্র সন্তান আমি। এটা যখন
বুঝলাম ।
–যখন বুঝলে ?
–বুঝলাম, আপনার পিছনে ঘুরাটা ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া ?
–তাছাড়া কি ?
–আপনার বোন, আমাকে পছন্দ করে না।
–কি বললে ? এক থাপ্পরে তোমার চাপার সব কটা দাঁত ।
–কেনো ?
–আর একবার ধনী দরিদ্র আর আমার বোনের কথা বললে কিন্তু ।
–বুঝলাম না, আমাকে এতো রাগ দেখাচ্ছেন কেনো ?
–রাগ দেখাই কেনো বুজতে পারছো না।
–না বুঝতে পারছি না।
–দীর্ঘদিন যাবৎ, গ্রামের সুন্দরী একটি মেয়ের পিছনে ঘুরেছো।
অথচ কখনো ভালোবাসার কথা বলতে পারোনি, কেনো ?
–ভয়ে।
–কিসের ভয় ? ভালোবাসায় বাধা বিপত্তি প্রতিবন্ধকতা আসবেই’ ?
–আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন ?
–নাহ।
–ওহ ঠিক আছে আমি গেলাম।
–কথাটি শুনা মাত্রই সূচনা সৈকতের শার্টের কলার ধরে বলতে
থাকে।
–আর যদি এক পা সামনে যাও, তবে এ মূহুর্তে আমার চেয়ে
খারাপ কেউ হবে না।
–তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। তাহলে থেকে কি হবে। আর
কি বলবে আমাকে ?
–তুমি কি জানো না মেয়েদের বুক ফোটে তবুও মুখ ফোটে না।
–তার মানে তুমি আমাকে ভালোবাসো ?
–হুম অনেক ভালোবাসি তোমাকে সৈকত।
–কিন্তু।
–আবার কিসের কিন্তু।
–তোমার বাবা আর বোন যদি এই সব জানতে পারে, তাহলে কি
হবে জানো তুমি।
–এই সব পরের চিন্তা। যদি বাবা সমস্যা করে তোমাকে নিয়ে
পালিয়ে যাবো ?
–তাই নাকি
–তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। তোমার সঙ্গে সারাটি
জীবন কাটাতে চাই সৈকত।
Leave a Reply