মানুষ মাত্রই প্রকৃতি ভালোবাসে। পাহাড়,ঝর্ণা, নদী,হাওর বাঁওড় আর বিল ঝিল কী না পছন্দ মানুষের ঋতু ভেদে! পাহাড়ের নৈসর্গিক সুনশান নীরবতা একলা আদিগন্ত দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে শেখায় ধৈর্য আর স্থিরতা যেকোনো পরিস্থিতিতে। আমারও পাহাড় ভালো লাগে।পাহাড়ের নিজস্ব চলা নিস্তব্ধতা চাপা কষ্ট তিলে তিলে প্রকৃতি রোপন করে দেয় বৈচিত্র্যময় সবুজের সমারোহ। পাহাড় চির সবুজ হয়ে ধরা দেয় ভূল্যোকে বিচ্ছুরিত সৌন্দর্যে। তখন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষক প্রকৃতির কূল ঘেঁষে পাহাড় হয়ে ওঠে নন্দিনী।
এতো সুন্দর পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে পাহাড়ি অঞ্চলে। রাঙামাটি, বান্দরবান, লামা,কিংবা সিলেট এমনি বাংলাদেশের প্রায়ই বিভাগে দেখতে পাবেন সুউচ্চ পাহাড়ের সারি সারি দেয়াল। মাঝে মাঝে পাহাড়ের মাঝে চিৎকার করে যে নাম বলবেন তা আরেক পাহাড়ের ধ্বনি ধাক্কায় আপনার কাছে ফেরত আসবে ঠিক তেমন প্রতিধ্বনি হয়ে। কী চমৎকার তাই না? আর জনয়ই হয়তো এই পাহাড়গুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সৃষ্টিকর্তা একদল সুদক্ষ সুঠাম দেহী, অত্যন্ত পরিশ্রমী লোক পাঠিয়েছেন যারা পাহাড়কে অত্যন্ত পবিত্র স্রষ্টার আমানত মনে করে। তারা আর কেউ নন আমাদের দেশের অধিবাসী নাগরিক চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো এমন আরো নানা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মানুষ।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজন খুবই কর্মঠ। তারা প্রায় খাদ্য শস্য নিজেরা ফলন করেন তাও পাহাড়ের উঁচু নিচু অববাহিকার উপত্যকায়। ভাবতে অবাক লাগে এমন চ্যালেঞ্জিং কাজটি করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওখানকার বসবাসরত নারীরা। সকালে কোলের শিশুকে পিঠে কাপড় দিয়ে বেঁধে চলে যান তারা মাথায় একধরনের তাদের বানানো বেতের ঝুড়ি নিয়ে। পাহাড়ের উঁচু নিচু পাড়ে কেমন করে যেন দুঃসাহসিক চাষাবাদ করেন তারা যাকে বলা হয় জুমচাষ। দুপুববেলা ভর্তা ভাত খেয়ে ফের কাজ শুরু করেন ওই পাহাড়ে নিবেদিত প্রাণ নারীরা। ধান চাষ থেকে শুরু আনারস কলা বাগান সব চাষা বাদই তারা করে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছেন প্রতিনিয়ত।
পাহাড়ী অঞ্চলে সমতলের মতো হাতের কাছে খাওয়ার বিশুদ্ধ পানি নেই বললেই চলে। ওখানে খাওয়ার পানির সংকট তীব্র। মাঝে মাঝে কয়েক মাইল দূর থেকে গিয়ে নারীরা পানি সংগ্রহ করে আনেন। অনেক দূরে ছড়া, কুয়ো থেকেও খাওয়ার পানি আনা হয় আবার তা নিয়ে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত বসতিতে পাহাড় বেয়ে উঠা চারটি খানি কাজ নয় বটে। বড়ই কঠিন দূরহ পথ পাড়ি দিতে হয় তাদের প্রতিনিয়ত। আমার তো মনেই হয় এতো পরিশ্রমী মহিলা যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন সেই পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন। ফলে তারা প্রায়শই অপুষ্টিতে ভোগেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেশি পাহাড়ে। চালাঘরগুলোও কেমন জানি অরক্ষিত মনে হয় আমার কাছে। বন্য হাতি এসে সবকিছু উলটপালট করে দিতে সেকেন্ড সময়ও লাগবে না। এরপর আরো আছে সমস্যা। প্রসূতি নারীদের তেমন কোনো স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় না দূর্গম পাহাড়ে। কোথায় ক্লিনিক কোথায় ডাক্তার আর নার্স আদিম উপায়ে দাত্রীর সাহায্যে তারা বাচ্চা প্রসব করান যা পাাহাড়ী নারীদের মৃত্যু হার বাড়ায়। সাথে জন্ম শিশুদেরও স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকেই যায়।
দূর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় পাহাড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার নাজুক অবস্থান লক্ষণীয়। তার উপর আছে শিক্ষক সংকট। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে।তারা ওই ভাষাতেই পড়ালেখা করতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের ভিতর থেকে সেরকম শিক্ষিত হওয়ার সুযোগই বা পাচ্ছে কতজন নর নারী তা সরকারী রিপোর্ট আর পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদনে আমরা দেখতে পাই। পাহাড়ে যদি নারীদের আলাদা করে শিক্ষা গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়গুলো শেখানো পড়ানো আর ডকুমেন্টারি দেখানো যেতো তবে পাহাড়ি নারীরা নিজের জন্য চলনসই একটি পন্থা খুঁজে পেতো। নিজের সন্তানের স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে গবাদিপশু পালন,উত্তম ও সহজ উপায়ে জুম চাষ সবকিছুই তারা সহজে করতে পারতো।
বর্তমান বিশ্বে নিজেদের এগিয়ে নিতে আরেকটি বিরাট সুযোগ প্রযুক্তিগত দিক। পাহাড়ে যদি স্বল্প খরচ ও সহজবোধ্যভাবে ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনা যেতো তাহলে মনে করি পাহাড়ি নারী পুরুষ সকলেই উপকৃত হতো। নিত্য নূতন জ্ঞান অর্জন করতে পারতো তারা পাহাড়ে বসেই। তখন উন্নয়নের উৎকর্ষতা পাহাড়ের নানাদিক ছড়িয়ে পড়তো। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা অত্যন্ত মেধাবী কারণ তারা সবসময়ই তাদের উৎপাদিত ভালো জিনিসটি খেয়ে থাকে যাতে ভেজাল নেই বললেই চলে। তাই তাদের যদি সময়তলের মূল জনশক্তির সাথে গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করা যায় তাহলে পাহাড়ের নারীরা সবচেয়ে বেশি উদ্যমী ও উপকৃত হতো।
আসুন সমতল আর পাহাড়িদের ভাগ না করে দেশের উন্নয়নে সবাই একসাথে কাজ করি। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়াই। তারা কখনোই এ দেশের বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীর মূল স্রোতে নিয়ে আপনার আমার সকলের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
“পাহাড়ি নারী কূল সুখের সুন্দর শত ফুল,
পরিশ্রমী উদ্যমী ওদের নাই কোনো তুল।”
Leave a Reply