শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫৮ পূর্বাহ্ন

টঙ্গীতে সরকারি গুদাম পড়ে আছে খালি-আবাসিক এলাকায় চলছে বিপজ্জনক ক্যামিক্যাল ব্যবসা

মৃণাল চৌধুরী সৈকত
  • আপলোডের সময় : শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৭৩ বার

টঙ্গীর আবাসিক এলাকা, বাসা বাড়ি, অলিগলি, বিপনীবিতান এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে ক্যামিক্যাল গুদামঘর তৈরি করে বিপজ্জনক এ ব্যবসা চালাচ্ছে স্থানীয় অর্থলোভী ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীরা।
আর বাসাবাড়ি, দোকান বা মার্কেট কিংবা গুদামঘর ভাড়া দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জায়গা, বাসাবাড়ি দোকান বা মার্কেট মালিকরা। অথচ সরকারিভাবে প্রায় একশ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ৫৩টি ক্যামিক্যাল গুদামঘর ভাড়া সংক্রান্ত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এবং স্থানীয় ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীদের চিঠি দিয়েও ভাড়া দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে আবাসিক ও জনবহুল এলাকায় বিপজ্জনক বিভিন্ন প্রকার ক্যামিক্যাল দাহ্য পদার্থ অতি-সহজেই যত্রতত্র পাওয়া যাওয়ায় এক অজানা আতঙ্কে ভুগছেন টঙ্গীবাসী। বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকার কাাঁঠালদিয়া এলাকায় এই সরকারি প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সরকারী প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ক্যামিক্যালের গুদাম থেকে ছড়ানো আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু এবং ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে ৭১জনের প্রানহানীর পর সরকার শিল্পমন্ত্রালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রনাধীন দুটি ক্যামিক্যাল ওয়্যারহাউজ নির্মানের উদ্যোগ নেন। একটি ঢাকার শ্যামপুরে ও আরেকটি টঙ্গীর কাঠালদিয়া এলাকায়। টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া এলাকায় ৬ একর জায়গায় ইতোমধ্যে ৯৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যায়ে ৫৩টি ওয়্যারহাউজ ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর মাসে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। চলতি মাসের ১৫ সেপ্টেম্বর এই সকল ওয়্যারহাউজ ভাড়া দেওয়ার জন্য জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পাশাপাশি টঙ্গীর ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ী এবং ক্যামিক্যাল এক্সপোটারদের বা মালিকদেরকে ক্যামিক্যাল গুদাম ভাড়া নেওয়ার জন্য চিঠিও দেন সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তর থেকে । বিজ্ঞপিতে আকর্ষণীয় জায়গায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ক্যামিক্যাল ব্যবসা ও সংরক্ষণের সকল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত নব-নির্মিত ক্যামিক্যাল গুদাম ও সংশ্লিষ্ট অফিস কক্ষগুলো ভাড়া দেওয়ার নিমিত্তে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিকট থেকে নির্ধারিত ফর্মে আবেদনপত্র আহবান করেন কর্তৃপক্ষ। গুদামের প্রতিটি প্যাকেজ (গুদাম ও অফিস) ২০৭২ হতে ৩৪১০ বর্গফুট জায়গা (ভ্যাট ব্যতীত) প্রতি বর্গফুট ২৬ টাকা হারে ভাড়া দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি ও ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ী বা গুদাম মালিকদের চিঠি দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কেউ ক্যামিক্যাল গুদামের জন্য আবেদন করেনি।
এ বিষয়ে প্রকল্প উপ-পরিচালক মো: সালমান মাহমুদ খান জানান, প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগে। আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও ক্যামিক্যাল ব্যবসার সাথে জড়িত মালিকদের চিঠি দিয়েছি। এখনও কেউ আবেদন করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে ক্যামিক্যাল গুদাম মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সব ক্যামিক্যাল দোকান বা গুদাম এখানে চলে আসলে বড় ধরণের দূর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে না।
এদিকে টঙ্গীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে ক্যামিক্যালের ব্যবসা করে আসছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেরই নেই সরকারি অনুমোদন। ক্যামিক্যাল বিস্ফোরণে ইতোপূর্বে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটলেও টনক নড়ছেনা ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীদের। স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করে চালাচ্ছে অধিক ঝুকিপূর্ণ এ ব্যবসা। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠা ক্যামিক্যাল ব্যবসার কারণে যেকোন মুহূর্তে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীরা যে যার মত দেদারসে ক্যামিক্যাল দিয়ে সয়লাব করে রেখেছে টঙ্গীর আবাসিক এলাকাগুলো। কেউ কেউ স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতার জোর দেখাচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যে। যার মধ্যে ফেমাস ক্যামিক্যালের মালিক ঈসমাইল হােসেন নাম অন্যতম বলে ছোট ছোট ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীদের দাবী।
সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি, মাকের্ট ও জনবহুল আবাসিক এলাকাসহ আনাচে-কানাচে শতাধিক ব্যাবসায়ী ক্যামিক্যালের ব্যবসা করে আসছেন। এলাকার গাজীবাড়ি, চম্পকালি সিনেমা হল রোড, ক্যাপরি সিনেমা হল, তিতাস গ্যাস রোড, মাতব্বর বাড়ি রোড, সাতরং গেইট, সাহারা মার্কেট, নতুন বাজারস্থ সমবায় কমপ্লেক্স মার্কেট, আমতলী, মরকুন টেকপাড়া এলাকায় ক্যামিক্যালের ব্যবসা করে এলাকাবাসীকে ঝুঁকির মুখে রেখেছেন এসব ব্যবসায়ীরা। এসব ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছে সমবায় কমপ্লেক্সে এমএস কর্পোরেশন, যমুনা কেমিক্যাল, নিউ পদ্মা কেমিক্যাল, মিতালী কেমিক্যাল, আল-মদিনা কেমিক্যাল, শাহ্ আলী কেমিক্যাল, ফারিয়া ট্রেডার্স, উর্মি ট্রেডার্স, জেটেক্স কর্পোরেশন, নিশি এন্টারপ্রাইজ, পূবালী কেমিকেল, খাঁন এন্টারপ্রইজ, ডিএ কর্পোরেশন, জিহাদ কালার, আমানত ট্রেডার্স, নজরুল এন্ড ব্রাদার্স, সেভেন স্টার কর্পোরেশন, সাদ ট্রেডিং, ফেমাস ক্যামিকেল, ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে ক্যাপরি সিনেমা হলের ভিতরে বাসু এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন গুদামে ক্যামিক্যাল ও অনুমোদনহীন ক্যামিক্যাল যেমন পটাশিয়াম, সালফিউরিক, হাইডোস, ব্লেসিং পাউডার জাতীয় মারাত্বক এবং ঝুকিপূর্ণ ক্যামিক্যাল বাজারজাত করছে। বেশীরভাগ ক্যামিক্যাল গুদামে কোন সাইনবোর্ড নেই। পুরো এলাকায় ক্যামিক্যালের উৎকটগন্ধ ছড়িয়ে শিশু থেকে নানা বয়সের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন টঙ্গী অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম জানান, আমরা ক্যামিক্যালের কোন প্রকার লাইসেন্স প্রদান করি না। ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়েছে কি না খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল জানান, আমরা কেমিক্যালের কোন লাইসেন্স দেই না।
এ ব্যাপারে (শনিবার বিকেল ৩ টায়) বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক ড. আসাদুল ইসলামের মুঠোফোনে যােগােযাগ করে উনাকে পাওয়া যায়নি।
টঙ্গী পূর্ব থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, আমরা এখনো কোন অভিযোগ পাইনি।অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত ২২ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর সাহারা মার্কেটে মো. ঈসমাইল হোসেনের ফেমাস ক্যামিক্যালের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ৪ জনসহ ৫ জন অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে ৬ জন আহত হয়। শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক খন্দকার জান্নাতুল নাঈম, ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ, ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদা ও দোকান কর্মচারী আল আমিন ওরফে বাবুর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিদ্বগ্ধ ফায়ার ফাইটার জয় হাসান চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। এই ঘটনার পর থেকে ফেমাস ক্যামিকেলের মালিক মো. ঈসমাইল হোসেন পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে, তাছাড়া এঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা বা কেউ আটক হয়নি থানা সূত্রে জানা গেছে।

আমাদের সাথেই থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই জাতীয় আরো খবর

Categories