বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা দিয়ে জরায়ুমুখের ক্যানসারের টিকা বানিয়ে বিক্রি করার অভিযোগে ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুন অর রশীদ জানান, নকল টিকা প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী চক্রটির সদস্যদের আটক ছাড়াও নকল টিকা তৈরির বেশ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে হেপাটাইটিস-বি টিকা, নকল টিকা তৈরির মেশিন এবং কয়েকটি মোটর যান।
রশীদ জানান, জরায়ু মুখের ক্যান্সারের টিকা হিসেবে পরিচিত সারভারিক্স গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশে আমদানি করা হয় না। বাংলাদেশে এটির আমদানি নিষিদ্ধ।যে টিকাটি জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের টিকা বলে বিক্রি করা হচ্ছিলো সেটি আসলে এই ক্যান্সারের টিকা নয়; বরং সেটি হেপাটাইটিস-বি টিকার সামান্য অংশ দিয়ে অবৈধভাবে তৈরি করা হতো।তিনি বলেন, ‘যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা স্বীকার করেছে যে তারা প্রতারণা করেছে।’তবে এই চক্রটির সাথে আরও কারা জড়িত সেটি এ বিষয়ে আরো তদন্ত শেষে বলা যাবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
যেভাবে কাজ করত চক্রটি
সংবাদ সম্মেলনে রশীদ বলেন, এই চক্রের একজন ভারত থেকে অবৈধভাবে হেপাটাইটিস-বি টিকা বাংলাদেশে আনতো এবং সেটি সে তার নিজের বাড়িতে মজুদ করতো। ভারত থেকে আনার সময় এটির দাম পড়ত ৩৫০ টাকা করে।পরে তার বাড়ি থেকে এই টিকা নিয়ে যাওয়া হতো কেরানীগঞ্জের একটি কারখানায়। সেখানে হেপাটাইটিস-বি টিকার শিশি ভেঙ্েেগ সেটি দিয়ে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের টিকা সারভারিক্সের নকল তৈরি করা হতো।
হেপাটাইটিস-বি এর একটি টিকা থেকে তৈরি করা হতো ১০টি জরায়ু মুখের ক্যান্সারের নকল টিকা। যার প্রত্যেকটি বিক্রি করা হতো ২৫০০ টাকা করে।কেরানীগঞ্জের কারখানা নকল টিকা তৈরির পর সেটি এই চক্রের বাকি চার সদস্য বাজারজাত করত।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই চক্রটি ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারণার মাধ্যমে নকল টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করতো। গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের প্রচারণা করেছে তারা। যার মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার মেয়ে শিক্ষার্থীকে এই নকল টিকা দিয়েছে তারা।এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছেও নকল এই সারভারিক্স টিকা বিক্রি করতো চক্রটি। এই চক্রের সাথে জড়িত আরও কয়েক জনের নাম জানতে পারার কথা জানিয়েছে পুলিশ।নকল টিকা বাজারজাতকরণের সঙ্গে কমপক্ষে তিনটি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
আইনে কী আছে?
নকল এবং ভেজাল ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনে কঠোর সাজার বিধান আছে।ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশে উৎপাদিত ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত ওষুধ, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে আমদানি করার কথা বলা হয়েছে সরকারের নীতিমালায়।
এ ছাড়া ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধে এ সম্পর্কিত নতুন একটি আইনের খসড়া এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদে পাস করা হয়েছে।গত ৬ ফেব্রুয়ারি ওষুধ ও কসমেটিক আইন- ২০২৩ এর যে খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে সেখানে নকল ও ভেজাল ওষুধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে।এই খসড়া আইন অনুযায়ী, অসৎ উদ্দেশ্যে ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি, নকল ওষুধ উৎপাদন ও তা জেনে বিক্রি করা, মজুদ বা প্রদর্শন এবং সরকারি ওষুধ বিক্রি বা মজুদ করলে ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারানণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।এ ছাড়া এই আইন অনুযায়ী, এই সংশ্লিষ্ট অপরাধের সাথে জড়িত থাকলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থার উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন বলেন, দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনি বিধিমালা রয়েছে।তিনি বলেন, বাংলাদেশে ওষুধ বিষয়ক যেসব আইন ও নীতিমালা রয়েছে সেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে মিলিতভাবে করা হয়েছে। তাই এতে কোন ঘাটতি নেই। তবে এসম্পর্কিত আইন কার্যকরে পর্যাপ্ত সাংগঠনিক কাঠামো ও জনবলের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নকল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। বাংলাদেশের সব জেলায় এই অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল না থাকায় জেলার সিভিল সার্জন এবং সিটি কর্পোরেশন এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহায়তায় এই কাজ করা হয়।তার মতে, নকল ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আরো প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল দরকার।তিনি বলেন, দৈব চয়নের ভিত্তিতে বাজার থেকে ওষুধ নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার যে সেগুলো ঠিক আছে কিনা।হোসেন বলেন, সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কঠোর হাতে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা
Leave a Reply