পাবনা জেলার অধীন ঈশ্বরদী উপজেলা। ফলে পাবনা শহরের নেতৃত্বে উপজেলাগুলো পরিচালিত হয় । একই কারণে পাবনা শহরের নেতাদের গুনাগুন উপজেলাতে পড়বে – সেটাই স্বাভাবিক।
এক সময় সম্মানীত বয়সীরা বলতেন- ‘যখন জাতীয় নির্বাচন হয়, তখন পাবনা সদর আসনের দিকে লক্ষ্য রাখো। দেখবে পাবনার সদর আসনে যে জিতবে, তার বিরোধী দলটি ক্ষমতায় আসবে।’ পাবনার লোকদের স্রোতের বিপরীতে চলা দীর্ঘদীনের অভ্যাস (তাত্ত্বিকরা বলেন বিপ্লবী মন)। জনৈক এনজিও বিশেষজ্ঞ একবার মত দিয়েছিলেন- এখানকার খাদ্য- শস্যে আয়োডিনের অভাব রয়েছে। সেজন্য তারা সব কিছু উল্টা বুঝে। এ জেলাতে ৬৯ সালে লালটুপি সম্মেলন হয়েছিল। মাওলানা ভাসানী না কি টিপু-মতিন-আলাউদ্দীনকে বলেছিলেন- তোমাগো মার্কস-লেলিন থাকতে আমারে লইয়া টানাটাানি করো কেন? ( উক্তিটি টিপু বিশ্বাসের ভায়রা ভাই সাবেক জাসদ নেতা লুৎফর মাস্টারের ‘স্মৃতির বেদনা মালা একলা গাথি’ নামক বই থেকে নেওয়া)। ভাসানী যাই বলুন না কেন, বিপ্লবীরা ঠিকই তার ঘাড়ে ভর করতে পেরেছিলেন। শেষমেশ ৭০ সালের নির্বাচন বর্জন। দুই কুকুড়ের কামড়াকামড়ির তত্ত্বের প্রয়োগ। তারা প্রথমে চারু মজুমদারের লাইন ধরলেও পরে লাইন পরিবর্তন করে নিজেরাই লাইন উদ্ভাবন করেন এবং পুর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে হেমায়েতপুরকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে। শোনা যায়, তাদের একটি অংশ স্বাধীনতার মাত্র দুইদিন আগে এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে বৈঠক করে পাকসেনাদের সঙ্গে হাত মেলায়। পরের ইতিহাস সকলের জানা।
স্বাধীনতার পর টিপু বিশ্বাসের প্রভাবে ‘বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী’ নামে একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম ঘটে। এ ছাত্র সংগঠনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একাধিকবার জয়ী হয়। পাবনা শহরে জন্ম ঘটে শিমুল বিশ্বাসের। ১৯৮৭ সালে শিমুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে একবার ছাত্র শিবিরের অফিস আক্রমণ হয় ( এই অভাগা সেদিন ছাত্র মৈত্রীর মিছিলে ছিলেন)। ৮৬ সালের নির্বাচনে তখন আওয়ামী লীগ থেকে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এমপি হয়েছিলেন। ঘটনার দুইদিন পর বকুল এমপি একটি আগুনে পোড়া কোরান শরীফ হাতে করে দাবী করেন-শিমুল বিশ্বাসের দল কোরান শরীফ পুড়িয়ে দিয়েছে। বকুল এমপি জামায়াত নেতা মাওলানা সোবহানের সাথে করে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে শিমুল বিশ্বাস গ্রেফতার হন। তখন বকুল ও তাদের খালাতো ভাইদের একচেটিয়া রাজত্ব। শহিদুল্লাহ বাচ্চু তখন যুবলীগের জনপ্রিয় নেতা। তিনি “পাবনার রাজনীতিতে স্থানীয়ত্ব কায়েম করো” নামে একটি অদ্ভুত তত্ত্ব হাজির করেন। অর্থাৎ বকুল ও তার ভাইয়েরা বিদেশি(মাত্র ৪০ কি.মি. দুরে শাহাজাদপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি), সেজন্য তাদেরকে পাবনা ছাড়া করতে হবে। শহীদুল্লাহ বাচ্চুর শিংয়ের গুতায় বকুল এমপি প্রায় ২০ হাজার কর্মী নিয়ে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বিএনপিতে যোগ দেন। যে শিমুল বিশ্বাস একসময় বকুলের ঘোরতর শত্রু ছিলেন, তিনিও পরবর্তীতে ২০/২৫ হাজার অনুসারী নিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। উল্লেখ্য, শহীদুল্লাহ বাচ্চু মুক্তিযুদ্ধে আলোচিত পাকবাহিনীর সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জায়েদির শ্যালক। শোনা যায়, ক্যাপ্টেন জায়েদির মধ্যস্থতায় নকশালদের একাংশ পাকসেনাদের সঙ্গে ঐক্য করেছিল। শহীদুল্লাহ্ বাচ্চু পরবর্তীতে পাবনার পৌরসভার চেয়ারম্যান হন এবং কতিপয় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন। রফিকুল ইসলাম বকুলের অনুসারী ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা কামরুল হাসান মিন্টু। তিনিও পরে বিএনপিতে যোগ দেন এবং পর পর তিনবার মেয়র পদে নির্বাচিত হন। সম্প্রতি তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছেন। গত পৌর নির্বাচনে তিনি প্রার্থী না হলেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সনি বিশ্বাসের পক্ষ নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে দল করা ত্যাগী নেতা শরীফ প্রধান দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। পাবনার পৌর নির্বাচনে নূর মোহাম্মদ মাসুম বগা ধানের শীষ প্রতীকে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনিও এক সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির নাতি এক পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর করে আলোচিত হয়েছেন। পুর্বে আওয়ামীলীগ যারা করতেন তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা অস্বীকার্য। তাদের অপরিসীম জানাশোনা ছিল। তাদের নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, সর্বশেষ মুক্তিযুদ্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম ঘটে। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামীলীগে নেতৃত্ব পেতে হলে পেশি শক্তি আর অর্থ শক্তি থাকতে হয়। এখন এ দলে আদর্শ খোঁজা আর ছাইয়ের গাদায় সুই খোঁজা একই কথা।
৯০ ভাগ নেতা-কর্মী ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইগুলোর নাম জানে কি না সন্দেহ। ব্যক্তিপুজা, পরিবার পুজা, অর্থ পুজা এখন মুল নীতি। এ দলে যে ব্যক্তি পেশি শক্তি দেখাতে পারে, সেই বড় নেতা। এখানে নওঁগার নক্সাল নেতা ওহিদুর রহমান উদাহরণ হতে পারে। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজশাহী বিভাগের ৯ টি জেলাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করেন। তাঁর অনুসারীদের হাতে আওয়ামীলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়। তিনি পরবর্তীতে আওয়ামীলীগে যোগ দেন এবং ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন( বর্তমানে তাঁর পুত্র আওয়ামীলীগের এমপি)। একই উদাহরণ সিরাজগঞ্জের জাসদ নেতা লতিফ মির্জা ও মাদারীপুরের জাসদ নেতা সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নাম বলা যেতে পারে। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ শাহাজাদপুরের জাসদ নেতা হালিমুল হক মিরু আওয়ামীলীগে যোগ দিয়ে একবার পৌর মেয়র ও আরেকবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে পেশিশক্তি দেখাতে না পেরে ছিটকে পড়েন। সম্প্রতি দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিমের অতীত ইতিহাস নিয়েও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রশ্ন আসা শুরু হয়েছে । পাবনার মতো ঈশ্বরদীতেও একবার ডিগবাজি দেখা গেছে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ডিলুপন্থী( সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ) কতিপয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মী আদাজল খেয়ে বিরোধিতায় নামে এবং তাঁকে মাঠ ছাড়া করে। তিনি ১৯৯৬ সালে মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যাদের শিং এর গুতোয় হাবিব দলছাড়া হয়েছিলেন, তারাই এখন বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছেন । গত ২৬ মে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন সাবেক পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু। তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন এবং ফল ঘোষণা হওয়ার পরপরই তার সমর্থকদের মারধর ও বাড়িতে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। শোনা যায়, তার সঙ্গে বিএনপির একাংশের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যদি দলে এভাবে আক্রমণ- পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে, তাহলে আগামীতে ঈশ্বরদীতেও পাবনার মতো ডিগবাজির রাজনীতির লীলাভূমি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
Leave a Reply