শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৮ পূর্বাহ্ন

এবছরের ফেব্রুয়ারীর প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হবে ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা

মৃণাল চৌধুরী সৈকত
  • আপলোডের সময় : শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ৩৩১ বার

বিশ্ব ইজতেমা শব্দটি বাংলা ও আরবি শব্দের সম্মিলনে সৃষ্ট: আরবি ‘ইজতেমা’ অর্থ সম্মিলন-সভা বা সমাবেশ। বিশ্ব ইজতেমা বা বিশ্ব ইজতিমা কিংবা বিশ^ এজতেমা, সাধারণত বৈশ্বিক যে কোনো বড় সমাবেশ, কিন্তু বিশেষ ভাবে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ বাংলাদেশে সোনাবানের শহর টঙ্গী’র এক সময়কার খরশ্রোতা কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে প্রতিবছর। আগে তাবলিগ জামাতের এই বার্ষিক মহাসমাবেশ এক পর্বে হলেও গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ অভ্যন্তরিন কোন্দলের কারণে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দিল্লির মাওলানা সা’দ অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় ৩দিন ব্যাপী এক পর্ব এবং কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা যোবায়ের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় ৩দিন ব্যাপী এক পর্ব। তাবলিগ জামাতের এই মহাসমাবেশটি হজে¦র পরে বিশ্বে সর্ববৃহৎ বিশ্ব ইজতেমা নামে পরিচিত। এতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রান্ত থেকে আসা ধর্মপ্রাণ লাখ লাখ মুসলমান। সাধারণত প্রতিবছর শীতকালে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ জন্য ডিসেম্বর বা জানুয়ারী মাসকে বেছে নেয়া হয়। যদিও ২০২৪ সালে এই বিশ্ব ইজতেমা বা ইসলামি মহাসমাবেশটি ফ্রেব্রুয়ারী মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে।

সূত্র অনুযায়ী, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ইসলামকি এই সমাবেশ নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। পরে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারপর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপর প্রতিবছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে টঙ্গীর পাগার গ্রামের সোসাইটি মাঠ হিসেবে পরিচিত খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়েছিলো। ওই বছর বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মগ্রাণ মুসলমানরা ইজতেমায় অংশ নেওয়ায় এটি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান অবধি এই ‘বিশ্ব ইজতেমা’ সোনাবানের শহর বা টঙ্গী’র এক সময়কার খরশ্রোতা কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীর সংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নীচু এবং রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সমর্থিত বর্তমার সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি’র ঐকান্তিত প্রচেষ্টা ও মাধ্যমে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সমূহের দ্বারা উক্ত বিশ্ব ইজতেমা মাঠের অভ্যন্তরে এবং চারপাশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেয়া দেশী-বিদেশী লক্ষ লক্ষ মুসল্লীদের যাতায়াতের সূবিধার্থে মাঠে ও মাঠের চারপাশে ডোবা-নালা, উঁচু-নীচু জায়গা ভরাট ও সমতলের মাধ্যমে পাকা রাস্তা নির্মাণ, মুসল্লীদের পয়:নিস্কাশনের জন্য একাধিক পয়নি:স্কাশন বহুলত ভবন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাসহ বিদেশী মেহমানদের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী টিনশেড নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় প্রতিবছর প্রতি পর্বে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়ে থাকেন।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস [রহ.] ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াাত বা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকা ভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমা কিংবা ইজতিমা অথবা এজতেমার আয়োজন করেন। সেই সূত্র ধরে বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র হলো রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদ। বাংলাদেশের গাজীপুর মহানগরস্থ সোনাবানের শহর টঙ্গী’র কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা বা ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের এই মহাসমাবেশটি কেন্দ্রীয় ভাবে রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদ থেকে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। পুরো সমাবেশের আয়োজনই করে থাকেন এক ঝাঁক ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক। মহান আল্লাহর নামে অর্থ, সম্পদ ও শারীরিক সহায়তা দিয়ে প্রথম থেকে শেষবধি তারা এই সমাবেশকে সফল করতে সচেষ্ট থাকেন প্রতিবছর।

পুরো সমাবেশস্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ, যা বাঁশের খুঁটির উপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বিদেশী মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে জেলা ভিত্তিক ভাগ করা হয়। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীগণ খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের জেলার অবস্থান সনাক্ত করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাওয়াারি মাঠের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে। বিদেশী মেহমানদের জন্য আলাদা নিরাপত্তা বেষ্টনীসমৃদ্ধ এলাকা থাকে, সেখানে মুসল্লি স্বেচ্ছাসেবকরা কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন, সেখানে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশের অধিকার দেয়া হয় না। তবে বিদেশী মেহমানদের জন্য নির্ধারিত প্যান্ডেলের চারপাশে র‌্যাব, পুলিশ, ও আনসার সদস্যরা সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা দায়িত্ব পালনসহ পূরো ইজতেমা ময়দানের চারপাশে বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর একাধিক ওয়াচ টাওয়ারসহ কয়েক হাজার আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য বিভিন্ন ভাবে দিনরাত ২৪ ঘন্টা লাখ লাখ মুসল্লীর নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করেন।
জানা যায়, সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন ৩দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত বা মনোবাঞ্চা পোষণ করেন। সে হিসাবেই প্রতিবছরই বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রতিবছর জানুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার আমবয়ান ও বাদ জুমা থেকে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। বলা হয়-প্রতি বছরই এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিশ্ব ইজতেমা প্রতিবছর দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয় কাকরাইল মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় এবং ৩দিন করে আলাদা সময়ে মোট ৬দিন এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বিশেষ একটি সূেত্র জানা যায়, বিশ্ব ইজতেমা ২০১০ সালের পর অভ্যন্তরিন কোন্দলের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দিল্লির মাওলানা সা’দ অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় ৩দিন ব্যাপী এক পর্ব এবং কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা যোবায়ের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় ৩দিন ব্যাপী এক পর্ব। মাঝখানে মাওলানা সা’দকে কেন্দ্র করে দু-গ্রুপের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হলেও বর্তমানে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হওয়ায়, আশা করা হচ্ছে-এ বছর শৃংখলাবদ্ধ হয়ে উভয় পক্ষের ৩দিন করে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
সূত্রটি জানায়, বিশ্ব ইজতেমা প্রথমে আ’ম বয়াান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয় এবং লক্ষ লক্ষ মুসল্লীর আগমনে আখেরি মোনাজাত বা সমাপণী প্রার্থণার মাধ্যমে শেষ হয়। অনেক সময় সাধারণ মুসলমান বা মুসল্লীরা ইজতেমায় ব্যয় করেন না, বরং শুধু জুমা’র নামাজে অংশগ্রহণ করেন কিংবা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলিম উম্মাহ অংশগ্রহণ করেন আখেরি মোনাজাতে। সেদিন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী), রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রপতি), বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি, সচিব, আইনশৃংলা বাহিনীর প্রধানগনসহ বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ আখেরি মোনাজাতে আলাদা-আলাদা ভাবে অংশগ্রহণ করেন থাকেন।
বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক সূত্র জানায়, সোনাবানের শহর টঙ্গী’র কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ তীরে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণজমায়তে বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হবে ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা। চলতি বছরে ইজতেমার প্রথম পর্ব মাওলানা মো. যোবায়ের হোসাইনের নেতৃত্বে ২ থেকে ৪ ফ্রেব্রুয়ারী এবং দ্বিতীয় পর্ব মাওলানা মো. ওয়াসিবুল ইসলামের নেতৃত্বে ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে।

আমাদের সাথেই থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই জাতীয় আরো খবর

Categories