৯ নভেম্বর আহ্সান উল্লাহ মাস্টারের ৭৪তম জন্মদিন। ১৯৫০ সালের এ দিনে তিনি গাজীপুরের হায়দরাবাদ গ্রামে এক সমভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন। তিনি ছিলেন শিক্ষক, শ্রমিক নেতা, রাজনীবিদ, সমাজকর্মী, জননেতা ও দক্ষ সংগঠক। ছিলেন নির্লোভ, নিরোগ, নিরহঙ্কার, পরোপকারী, ও দেশপ্রেমিক। জীবনভর দিয়েছেন সব সময় উজাড় করে, নেননি কিছুই। হৃদয় দিয়েই ভালবাসতেন সুহৃদসহ ছোট-বড় সকলকেই, যে ভালবাসা ছিল নিখাদ, নির্ভেজাল। রাগ, ক্ষোভ, জেদ, বিরক্তি, অসহিষ্ণুতা, মুখভার- এগুলোর একটিও তার মধ্যে দেখা যায়নি কোন দিন। তার কথায় কিংবা ব্যবহারে কেউ আহত হয়েছেন এমন নজির নেই। সংবাদকর্মীরা ছিল তার খুব কাছের তথা আত্মীয়তুল্য আপনজন, যে কোন কাজে তার কাছে কেউ সহযোগিতা চেয়ে পাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আহসান উল্লাহ সমাজ ও মানুষের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন ও স্বপ্ন দেখতেন। সেই ভাবনা ও স্বপ্নের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সুবিধাবঞ্চিত মেহনতি মানুষ। মেহনতি ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি আজীবন কাজ করেছেন। তিনি মানবিক গুণাবলিতে উজ্জীবিত একজন পরিশুদ্ধ মৌলিক মানুষ ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ৬২’র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন ও ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের পাশাপাশি সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে তিনি আজীবন কাজ করেছেন। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সমাজের অসহায় মানুষের সহায়তায় তিনি সর্বদা ছিলেন নিবেদিত। সব শ্রেণী পেশার মানুষের কল্যাণে তিনি কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন শ্রমিকদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও দরদী নেতা। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। ফলে তিনি শ্রমিক ও জনতার দরদী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তিনি মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম-লড়াই করেছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তিনি কখনো আপস করেননি। তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনে যতবার প্রার্থী হয়েছেন, জনগণের বিপুল ভোটে ততবারই তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তার এলাকার জনগণের হৃদয় জয় করেছিলেন অকৃত্তিম ভালবাসার মাধ্যমে।
১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার উপজেলা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে দেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিয়ে আহসান উল্লাহ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ জন্যে তিনি জেল, জুলুম, নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। উপজেলা পদ্ধতি বিলোপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন। তারই মামলার ফলে আদালত স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক স্তর বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছিল। এ নির্দেশনা আজ দেশে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তব ফল হিসেবে বিরাজ করছে। হাইকোর্ট মামলার রায়ে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক স্থর হিসেবে ঘোষণা করে।
শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়ন, পেশাগত ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ও প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানী বন্ধ করার দাবি নিয়ে তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন প্রতিনিয়ত। দেশে যখন ত্রাস ও গ্রাসের রাজনীতির বলয় তৈরী হয়েছে, তখনই এসকল অপরাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে বিভিন্ন কর্মসূচিতে আহসান উল্লাহকে দেখা গেছে টঙ্গীর ও ঢাকার রাজপথে। তিনি ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫, ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক পটভূমিতে শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের নেতা হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা গর্বের ও অহংকারের। আজীবন তিনি গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। আহসান উল্লাহের অবদান কখনো বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যাবে না। তার আদর্শ ও কর্মে তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
মানুষকে আপন করে কাছে নেয়ার অমিত ক্ষমতা ছিল তার। তার মধ্যে ছিল এমনই শক্তি, যে শক্তির ক্ষমতায় তিনি অল্প সময়ে যে কারো মন জয় করতে পারতেন। ফলে যেখানেই তিনি অংশ নিয়েছেন, সেখানেই ছিল তার সর্বোচ্চ সাফল্য। তিনি ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা, গণমানুষের নেতা ও শ্রমিকদের বন্ধু। সততা ও নৈতিকতা ছিল তার কাছে সবার আগে। এলাকার সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও অস্ত্রের ঝনঝনানির বিরুদ্ধে। মাদকের বিরুদ্ধে তার ছিল শক্ত অবস্থান। সব মিলিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের এতটাই আপনজন হয়ে উঠেছিলেন যে, গাজীপুরের রাজনীতিতে তার বিকল্প অন্য কাউকে ভাববার কোন কথা কখনো চিন্তা করতে পারছিলেন না স্থানীয় জনগণ। হয়তো এটাই হচ্ছে তার জন্য কাল। সঙ্গত কারণেই তিনি হয়ে যান অনেকেরই ঈর্ষার কারণ। বিশেষ করে তার প্রতিদ্বন্দ্বি বিপরীত মেরুর অনেকেই তাকে সহ্য করতে পারছিলেন না। যার ফলে অকালেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। ঘাতকের বুলেট তাকে চিরতরে বিদায় দিয়েছে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে তিনি বেঁচে আছেন, চিরকাল বেঁচে থাকবেন নিজের সততার জন্যে।
২০০৪ সালের ৭ মে এক দল সন্ত্রাসী টঙ্গীর নোয়াগাঁও এমএ মজিদ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় এ নির্ভীক জনপ্রিয় নেতাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু তিনি যুগে যুগে বেঁচে থাকবেন তার কর্মে, আহ্সান উল্লাহ’র মৃত্যু নেই। তারা মরতে পারে না। তারা অজেয় চিরকাল আমাদের এ ভূবনে। আহ্সান উল্লাহ চিরকাল বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। দেশের আন্দোলন, সংগ্রাম, অধিকার নিশ্চিতকরণে আহসান উল্লাহ’র নাম চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। তিনি সততা, আদর্শের ইতিহাস তৈরি করে গেছেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর, ২০০৪ এর ২১ আগস্ট ও ২০০৪ সালের ৭ মে আহসান উল্লাহ হত্যাকান্ড – একই সূত্রে গাঁথা। স্বাধীনতা বিরোধীরা বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে হত্যা করার জন্য এসব হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আহসান উল্লাহ গাজীপুরের মাটি ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে গেছেন, তা শ্রদ্ধার সাথে জনগণ স্মরণ করবে চিরদিন।
আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না। আহসান উল্লাহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন পরিশুদ্ধ মানুষ ছিলেন। আহসান উল্লাহকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদক স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১ দেয়া হয়। এ জন্যে শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় আহসান উল্লাহ ছিলেন আপোষহীন। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ। এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি আমাদের দেশের আদর্শিক রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বহুবিধ গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক, নির্বিরোধ, সহজ-সরল ও মিশুক একজন মানুষ। আমি নির্দ্বিধায় বলছি, জীবনে এমন কোন পরোপকারী পরিচ্ছন্ন মানুষ দেখিনি, যাকে আহ্সান উল্লাহের কাছাকাছি বসানো যায়।
আহসান উল্লাহ একজন গণমাধ্যমবান্ধব মানুষ ছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে ছিলেন অতিপ্রিয়। সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে ও গণমাধ্যমকর্মীদের সমস্যা সমাধানে আহসান উল্লাহ সর্বদা ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়নে ও অধিকার আদায়ে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তিনি গঠন মূলক বক্তব্য দিয়েছেন। সাংবাদিকদের সাথে সব সময় তার সুসম্পর্ক ছিল। তিনি সব শ্রেণী পেশার মানুষের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকতেন।
এ স্বচ্ছ, সৎ ও পরিশুদ্ধ মানুষ আহসান উল্লাহকে ১৯ বছর আগে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় বক্তৃতা করার সময় প্রকাশ্যে গুলি করে সন্ত্রাসীরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আহসান উল্লাহের ৭৪তম জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
Leave a Reply