সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:২৮ অপরাহ্ন

দূর্গাপূজা কি ও কেনো ? দুর্গা পূঁজার মাহাত্ব

মৃণাল চৌধুরী সৈকত
  • আপলোডের সময় : সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২
  • ১৬৪ বার

পূঁজা মানে পূনঃজাগরন। অর্থাৎ মনের ভেতরে বার বার ভগবানকে জাগিয়ে তোলাকেই ভগবানের পূঁজা বলে। ভগবানকে সন্তুষ্ট করার জন্য যদিও গঙ্গা-কাশী তীর্থে যেতে হয় না কিংবা বড় বড় মন্দিরে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে হয় না। আপনার মনের মন্দিরে যে পরমেশ্বর বসবাস করেন, তাকে জাগিয়ে তুলুন, উপলদ্ধি করুন তাতেই ভগবান সন্তুষ্ট।
সনাতন বা হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মগ্রহ্ন অনুসারে দেবদেবী বলতে হিন্দু ধর্মের উপাস্যকে বোঝানো হয়ে থাকে। বৈচিত্রপূর্ণ এই ধর্মে উপাস্য বোঝাতে দেব-দেবী, ঈশ্বর, ভগবান, ভগবতী ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সনাতন বা হিন্দুদের দেব-দেবীগণ বৈদিক যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক) ও মধ্যযুগে (খ্রীষ্টীয় প্রথম শতক) নেপাল, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু বিবর্তনের মধ্যদিয়ে-বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে সনাতন বা হিন্দু ধর্মের পূঁজারীরা। সনাতন বা হিন্দুদের দেবতা বলতে যোগশাস্ত্রের ইষ্ট দেবতা এবং তেত্রিশ বৈদিক দেবতা এমনকি শতাধিক পৌরাণিক দেবতাদের কথা বোঝানো হয়েছে। দেব-দেবতাদের মধ্যে মুখ্য দেবতারা হলেন বিষ্ণু, শিব, শ্রী বা লক্ষ্মী, পার্বতী বা দুর্গা, ব্রহ্মা, সরস্বতী প্রভৃতি। প্রত্যেক দেবতার আলাদা আলাদা চরিত্রাবলী বিদ্যমান হলেও তাদেরকে অনেক সময়ই “ব্রহ্ম” নামে এবং এক নিরাকার পরম সত্তার অংশবিশেষ বলে ধরা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এই একত্ববাদের ধারণা সনাতন বা হিন্দু ধর্মের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য, যা ধর্মশাস্ত্র এবং হরিহর (শিব ও বিষ্ণু), অর্ধনারীশ্বর (অর্ধেক শিব অর্ধেক পার্বতী)-এর মতো মূর্তিগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়। মূলত, মুখ্য দেবতার উপাসকরা সনাতন বা হিন্দু ধর্মের ভিন্ন শাখাগুলোর জন্ম দিয়েছেন। যেমন: শৈবমত, বৈষ্ণবমত ও শাক্তমত। এসব শাখাগুলোর মধ্যে একে অপরের মিল পাওয়া যায়।
সনাতন বা হিন্দু ধর্মের দেবতাদেরকে বিভিন্ন প্রতীকের দ্বারা বুঝানো হয়ে থাকে, যেমন ছবি বা প্রতিমা। আর্য সমাজ বা ব্রাহ্ম সমাজের মতো ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মমতগুলো একাধিক দেবতার ধারণাকে বাতিল করে নিরাকার একেশ্বর-বিশ্বাসের পথে হেঁটেছেন। জৈনধর্ম বা বর্হি ভারতীয়, থাইল্যান্ড বা জাপানিজ বৌদ্ধ বিশ্বাসে সনাতন বা হিন্দু দেবতাদের আপন করে নেওয়া হয়েছে। এখনও এসব দেবতাদের সেই সব ধর্মীয় মন্দিরে বা শিল্পে দেখা যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শাস্ত্রে মানব শরীরকে এক মন্দির বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ভগবান মানব মন্দিরেই বাস করেন। একই ভাবে ব্রহ্ম বা পরমতম সত্তাকে আত্মা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সনাতন বা হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই আত্মা শাশ্বত ও চৈতন্যের কারণ।
এবার আসা যাক, দূর্গা পূজা কী ও কেনো? এই দুর্গা আসলে কে ? সাধারণ ভাবে আমরা জানি, অসুররা যখন দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ দখল করেছিলো, তখন সকল দেবতার মিলিত শক্তিতে দেবী দুর্গার উৎপত্তি হয় এবং এই দুর্গা অসুরদের পরাজিত করে দেবতাদের বাসস্থান এবং স্বর্গ উদ্ধার করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সকল দেবতার মিলিত শক্তিতে সৃষ্ট নারীরূপী দুর্গা যদি একা সকল অসুরকে পরাজিত করতে পারে, তাহলে সকল দেবতা মিলে তা করতে পারলো না কেনো ? এখানে শক্তি তো সমান?
এখন ইন্টারনেট-ফেইসবুকের দুনিয়া, তাই বিভিন্ন ধর্মের বিধি বিধান নিয়ে অনলাইন ছাড়াও অফলাইনে সাধারণ লোকজন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন, এরমধ্যে সনাতন বা হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অন্যদের আক্রমনই চোখে পড়ে বেশী। তাই, সনাতন বা হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অবক্ষয় ঠেকাতে এবং সনাতন বা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে এ সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে ও ফিরিয়ে আনতে, হিন্দু ধর্মে পালনীয় প্রথার গূঢ়তত্ত্ব সম্পকের্র সকল কিছু-সকল সনাতনী বা হিন্দু সম্প্রদায়ের জানা একান্ত জরুরী। না হলে অন্যন্য ধর্মের আগ্রাসী আক্রমনে সনাতন বা হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই আপনাদের জন্য দুর্গাপূজা উপলক্ষে, দেবী দুর্গা এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমার এই ক্ষুদ্র নিবেদন।
সনাতন বা হিন্দু শাস্ত্র মতে, মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ‘ব্রহ্ম’ বলা হয়। এই ব্রহ্ম তিনটি রূপে বিশ্বভ্রহ্মান্ডের কাজ সম্পন্ন করে থাকেন-যথাযথ : ব্রহ্মা রূপে সৃষ্টি, বিষ্ণু রূপে পালন এবং মহাদেব বা শিব রূপে ধ্বংস। কিন্তু অজ্ঞতা ও বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে এতদিন অনেকেই মনে করেছেন বা জেনে এসেছেন, ব্রহ্মের তিনটি রূপ বা ব্রহ্ম তিনভাগে বিভক্ত, যথা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে আলাদা আলাদা তিনটি সত্ত্বা বিবেচনা করে আলাদা আলাদা মূর্তি তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের প্রত্যকের স্ত্রী সৃষ্টি, বহু দেবতার জন্ম, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে সে রকম কিছু নয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে : একজন লেখক যখন কল্পনা করে কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখেন, তখন লেখক কিন্তু একাই সমস্ত চরিত্র সৃষ্টি করেন। এর মানে হলো নায়কও লেখক, নায়িকাও লেখক, নায়ক-নায়িকার পিতা-মাতাও লেখক আবার ভিলেন এবং সকল পার্শ্ব চরিত্রও লেখক। অর্থাৎ লেখক একাই ঐ গল্প বা উপন্যাসে সবাইকে সৃষ্টি করেন এবং যাকে যেভাবে ইচ্ছা চালিত করেন এবং যার মুখ দিয়ে সময় উপযোগী সংলাপ সৃষ্টি করেন। ঠিক একইভাবে এই মহাবিশ্ব, তার মধ্যে পৃথিবী এবং তার উপর মানুষসহ সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ, পাহাড়, পর্বত, নদীনালা, খালবিল, সাগড়-মহাসাগড় সৃষ্টি করেন পরমব্রহ্ম এবং সেই একই কাজ করে চলেছেন। এখানে আর কারো কোনো ভূমিকা আছে বলে জানা নেই। সকল ভূমিকা কেবল ঈশ্বররূপী পরমেশ্বর বা পরমব্রহ্মের। ঠিক এই কথাই বলা আছে, দেবী দুর্গার শুম্ভ নিশুম্ভ বধ প্রসঙ্গে। দূর্গার সাথে যুদ্ধের সময় অসুররা দুর্গার বিরুদ্ধে রক্তবীজ নামক এক দৈত্যকে প্রেরণ করেন শুম্ভ নিশুম্ভ। এই রক্তবীজের বৈশিষ্ট্য হলো তার দেহ থেকে রক্ত মাটিতে পড়লেই তা থেকে আবার নতুন অসুরের উৎপত্তি হয়। রক্তবীজের রক্ত যাতে মাটিতে না পড়ে, সে জন্য দুর্গা নিজের থেকেই কালীকে সৃষ্টি করেন, তখন কালী রক্তবীজের রক্তপান করে তাদের উৎপত্তি বন্ধ করেন। এভাবে দুর্গা সমস্ত অসুরকে হত্যা করেন। এটা দেখে অসুর শুম্ভ-দেবী দুর্গাকে বলেন, “তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।” তখন দেবী দুর্গা বলেন,“একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।” অর্থাৎ, একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে রে দুষ্ট, এই সকল দেবী আমারই বিভূতি। দ্যাখ্, এরা আমার দেহে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য সকল দেবী, যাদেরকে দুর্গা দেবী কালীর আগে সৃষ্টি করেছিলো, তারা সবাই দুর্গার দেহে বিলীন হয়ে যায় এবং দুর্গা শুম্ভকে যুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্গা কেনো বললেন, একা আমিই এ জগতে বিরাজিত ? আসলে দুর্গা মানেই তো শিব বা মহেশ্বর, আর মহেশ্বর মানেই পরমব্রহ্ম।
একই কথা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতার সপ্তম অধ্যায়ে। গীতার সপ্তম অধ্যায়ের মূল কথা হলো, “এই জগতের সকল কিছুই আমা হতে উৎপত্তি, জগতের এমন কিছু নেই যাতে আমি নেই।” তাহলে কৃষ্ণ কেনো একথা বললেন? আসলে কৃষ্ণ যেহেতু বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার, সেহেতু কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু এবং আগেই ব্যাখ্যা দিয়েছি বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম। তাহলে প্রশ্ন, এত দেব-দেবী এলো কোথা থেকে ?
আমাদের পরমজ্ঞানী মুনি-ঋষিরা, পরমব্রহ্ম কর্তৃক এই বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেব-দেবীগুলোকে নানা ভূমিকায় কল্পনা করে নিয়েছেন বা ধরে নিয়েছেন, যেমন আমরা কোনো অঙ্ক সমাধান করতে গিয়ে ‘এক্স’কে ধরে নিই। কিন্তু বাস্তবে এক্স কিছুই না, কিন্তু এই এক্স একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আমাদেরকে সাহায্য করে। আমাদের পরমব্রহ্মকে খুঁজে বের করা বা তাকে উপলব্ধি করার জন্যই এই এক্স।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই মুনি-ঋষিদের কথাই যে সত্য, সেটা আমরা বুঝবো কিভাবে, আর মুনি ঋষিদের কথাকে আমরা সত্য বলেই বা মানবো কেনো? এ ক্ষেত্রে অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তবে আজ শুধু একটি উদাহরণ দেই, আমাদের সৌর জগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো, যে গুলোকে এখনও আমরা খালি চোখে ‘তারা’ বলে মনে করে থাকি, যে গুলোর মধ্যে পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশি এবং উপগ্রহ চাঁদ ছাড়া আর কোনো গ্রহে মানুষ এখন পর্যন্ত যেতে পারেনি, সেই গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানীরা জানতে শুরু করেছে, মাত্র কয়েকশত বছর আগে থেকে, কিন্তু ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র, যেটা হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ ‘বেদ’ এর অংশ, যা আমাদের মুনি-ঋষিরা লিখে গিয়েছেন ৮/১০ হাজার বছর আগে। সেই জ্যোতিষ শাস্ত্রে শুধু আমাদের সৌর জগতের প্রধান গ্রহগুলো সম্পর্কেই নয়, আমাদের সৌর জগতকে ঘিরে থাকা ২৭টি নক্ষত্র সম্পর্কেও বলে গেছেন।
মুনি-ঋষিরা গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে যা বলে গেছেন, তার সবগুলো তো এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়, সকলেই জানার জন্য মাত্র একটি উদাহরণ : মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন, মঙ্গল গ্রহের রং লাল, এখন বিজ্ঞানীরা তাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির দ্বারা মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণ করে বলছেন, হ্যাঁ মঙ্গল গ্রহের রং লাল। তাহলে সেই ৮/১০ হাজার বছর আগে আমাদের মুনি-ঋষিরা সেটা জানলো কিভাবে, তারা তো আর মঙ্গলগ্রহে গিয়ে দেখে এসে ঐ তথ্য লিখেনি ? শুধু তাই নয়, জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, চাঁদের প্রভাবে পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয়, এখন বিজ্ঞানীরাও তাই স্বীকার করছেন। তাহলে এই মুনি-ঋষি, যাদের সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাকে ভাবলে শুধু অবাকই হতে হয়, তাদের কথাকে আপনি বিশ্বাস করবেন না কেনো ? যারা জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, তাদেরকে বলছি, ওই মুনি-ঋষিরাই বলে গেছেন, মানুষের জীবনের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব এবং তার ফলাফলের কথা, তাহলে তাদের সেই কথাকে আপনি অবিশ্বাস করবেন কি ভাবে ? আপনি হয়তো কোনো জ্যোতিষীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন বা কারো প্রতারিত হওয়ার গল্প শুনেছেন, তার মানে তো এই নয় যে জ্যোতিষ শাস্ত্র ভূয়া! প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার জন্য ডাক্তার খারাপ হতে পারে, তাই বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান ভূয়া নয়, তেমনি জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে জ্যোতিষী ভূয়া হতে পারে কিন্তু জ্যোতিষ শাস্ত্র বা বেদ এক বিন্দুও মিথ্যা নয়।
যাই হোক, ফিরে যাই দুর্গার গল্পে। উপরেই উল্লেখ করেছি-ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, ব্র্রহ্ম যখন সৃষ্টির কাজ করেন তখন তিনি ব্রহ্মা, যখন তিনি পালনের কাজ করেন তখন তিনি বিষ্ণু, আর যখন তিনি ধ্বংসের কাজ করেন, তখন তিনিই মহেশ্বর। একটি উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও সহজ হবে, ধরে নিন, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনটি মন্ত্রণালয় আছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি ঐ মন্ত্রণালয় গুলোও দেখাশোনা করেন। এই অবস্থায় তিনি যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে ফাইলে সই করেন বা করবেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং ব্রহ্মের ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। তাই যদি না হয়, তাহলে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার কৃষ্ণ, পালনের পাশাপাশি যুদ্ধ ও হত্যার মাধ্যমে পাপী ও দ্ষ্টুদের বিনাশ করেছেন কেনো ? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে যদি আলাদা আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের কাজ ছিলো শুধু পালন করা, তার তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাঁধানোর কোন প্রয়োজন ছিলো না, প্রয়োজন ছিলো না শিশুকালেই রাক্ষসী ও অসুরদের, পরে কংস ও শিশুপালকে হত্যা করার এবং ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ ও দুর্যোধনকে হত্যা করানোর। আসলে কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু, আর বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম। এ জন্য বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে শুধু মানবরূপী কৃষ্ণই নয়, প্রত্যেকটি মানুষ যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন এক অর্থে সেই ব্রহ্মা। যখন কাউকে পালন করে তখন বিষ্ণু এবং যখন কাউকে ধ্বংস করে তখন শিব বা মহশে^র। এসব রূপেই প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে পরমব্রহ্ম বসবাস করেন। ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩/১৪/১) ও বেদান্ত দর্শনে বলা হয়েছে, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” অর্থাৎ, সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম বিদ্যমান বা বিরাজমান।
আগেই উল্লেখ করেছি, ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা। আর কোনো কিছু সৃষ্টি করতে লাগে জ্ঞান। প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে। প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কল্পনা করে নিয়েছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই। একজন লেখক কর্তৃক-গল্প, উপন্যাসে একাধিক চরিত্র সৃষ্টির মতো সবই ব্রহ্মের খেলা, এখানে ব্রহ্মই সবকিছু। যাই হোক, কোনো কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করতে হলে যেমন জ্ঞান লাগে, তেমনি সৃষ্টিকে নিখুঁত করার জন্য নজর রাখতে হয় চারদিকে, এ জন্যই কল্পনা করা হয়েছে ব্রহ্মার চারটি মাথা এবং তার নারীশক্তি সরস্বতীকে জ্ঞানের দেবী হিসেবে। এবার আসা যাক বিষ্ণুতে। বিষ্ণু হলো ব্রহ্মার পালনকারী রূপের নাম। কাউকে পালন করতে লাগে ধন-সম্পদ। এজন্যই বিষ্ণুর নারী শক্তি হলো লক্ষ্মী এবং সে ধন-সম্পদের দেবী।
শিব বা মহেশ্বরে। ব্রহ্মের ধ্বংসকারী রূপের নাম শিব, মহেশ্বর বা রুদ্র। সৃষ্টি বা পালন করতে যেমন লাগে নারী শক্তি, তেমনি ধ্বংস করতেও লাগে নারীশক্তি। এ কারণেই রামায়ণের সীতা ও মহাভারতের দ্রৌপদীর জন্ম। এছাড়াও বিখ্যাত গ্রীস ও ট্রয়ের মধ্যকার যুদ্ধের কারণও ছিলো একজন নারী, তার নাম ছিলো হেলেন। নারী শক্তি যেমন ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তেমনি নারী নিজেও ধ্বংস করতে পারে। প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দিতেই ব্রহ্মের ধ্বংসকারী রূপ মহেশ্বর বা শিবের নারীশক্তি হলো দেবী দূর্গা, যার আরেক রূপের নাম মা কালী। এই হলো হিন্দু শাস্ত্রের ইতিহাসে দুর্গার উৎপত্তির কাহিনী। কিন্তু এই কথাগুলোকে এভাবে না বলে আমাদের পুরাণ রচয়িতারা নানা ঘটনার মধদিয়ে বিভিন্ন দেব-দেবীর জন্ম দিয়েছেন। ঘটনাগুলো যুক্তি-তর্ক-প্রশ্নের বাইরে নয়। শুরুতেই উল্লেখ করেছি, সকল দেবতার শক্তি মিলে উৎপত্তি দেবী দুর্গা যদি অসুরদের হত্যা করতে পারে, তাহলে সকল দেবতা মিলে তা করতে পারলো না কেনো ? এই ঘটনায় প্রকৃতির নিয়মকে অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ, প্রকৃতির নিয়মই হলো একের চেয়ে বহুর শক্তি বেশি, কিন্তু এখানে বলা হয়েছে বহুর চেয়ে একের শক্তি বেশি, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছা করলে তার একার শক্তির দ্বারাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমগ্র কুরুবংশকে ধ্বংস করতে পারতেন, রাম পারতেন রাবনের বংশকে বিনাশ করতে, কিন্তু তা না করে একটি পদ্ধতিগত যুদ্ধের সাহায্য নিলেন ? কারণ, এটাই বাস্তব এবং তা লোকশিক্ষার উপযোগী ছিলো। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দূর্গার একার যুদ্ধ সম্পূর্ণ অবাস্তব।
পুরাণের গল্পগুলো নিয়ে কিছু বলা দরকার। যেমন, পুরাণের গল্পগুলো রচিত হয়েছে বেদ’র সূত্র নিয়ে। কিন্তু পুরাণ রচয়িতারা সব সময় সূত্রগুলো যে ঠিক মতো বুঝতে পেরেছেন, এনিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ-একই বিষয়ে একেক পুরাণে একেক রকমের কথা বলা আছে। উদারহণ স্বরুপ-গনেশের উৎপত্তির গল্প আপনি যত পুরাণে পাবেন, সবটাতেই দেখবেন আলাদা আলাদা গল্প। সবাই যদি বেদ এর সূত্রগুলো ঠিক মতো বুঝাতে বা বুঝতে পারতো তাহলে সব গল্পই এক রকম হতো। লোক শিক্ষার জন্য আমাদের পুরাণ রচয়িতারা এই গল্পগুলো লিখেছেন বলে অনেকের ধারনা।
দেব-দেবীর উৎপত্তি রহস্যের পর এবার দূর্গাপূঁজা ও তার বাস্তবতার ব্যাপারগুলো নিয়ে নজর দেওয়া যাক। দূর্গা কাঠামোতে প্রথমেই যেটা নজরে আসে, সেটা হলো দুর্গার ১০ হাত। আমাদের পুরাণ রচয়িতারা দুর্গার আবির্ভাবের পর তাকে সুপারওম্যান হিসেবে পাওয়ার ফুল করার জন্য প্রথমে ৪ হাত, তারপর ৮ হাত, তারপর ১৬ হাত এবং সবশেষে ১৮ হাত পর্যন্ত দিয়েছিলেন। যেহেতু প্রকৃতির নিয়ম হলো যত হাত তত শক্তি, কিন্তু এই ১৬/১৮ হাত অবাস্তব বিবেচনা করে, শেষ পর্যন্ত বাস্তবের ১০ দিককে ঠেকানোর জন্য ১০ হাত ঠিক করেন এবং সেই থেকে এখন পর্যন্ত সেটাই জনপ্রিয় এবং সেটাই চলছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, যে সকল পুরাণ ও উপ-পুরাণে দূর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলি হলো- মৎস্যপুরাণ, মার্কয়ে পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। দূর্গা বা দুর্গা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে যেমন- জয় দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বন দূর্গা, চন্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূঁজিতা হন দেবীদূর্গা।
দূর্গার হাতের পর দুর্গার পায়ের নিচে থাকা সিংহকে নিয়ে আলোচনায় আসি। প্রচলিত মতানুযায়ী অনেকেই জানেন, দূর্গার বাহন হলো সিংহ। কিন্তু দেবতাদের এই বাহন সংক্রান্ত ধারণাটাই একটা মিথ্যা ধারণা। প্রত্যেক দেবতা এমনিতেই তো অসম শক্তির অধিকারী, তাদের আবার বাহনের প্রয়োজন কি ? বাস্তবতা বিবেচনা করলে সিংহ না হয় অনেক বড় ও শক্তিশালী, তাই সিংহের হয়তো দূর্গাকে বহন করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু ময়ূরের কি কার্তিককে বহন করার ক্ষমতা আছে ? নাকি ইঁদুরের গনেশকে ? তাহলে ময়ূর ও ইঁদুরকে তাদের বাহন বলছি কেনো ? প্রকৃপক্ষে এই সব জীবজন্তু ঐসব দেব-দেবীর বাহন নয়, তারা প্রকাশ করে অন্য কিছু। যেমন : সিংহ হলো দূর্গার তেজ, ক্রোধ ও হিং¯্রতার প্রতীক। এমনটাই বলা আছে পদ্মপুরানে। পদ্মপুরানে বলা আছে, দুর্গার ক্রোধ থেকে সিংহের জন্ম হয়, আসলে দেব-দেবী ও তাদের বাহনদের জন্ম নিয়ে দন্ধ রয়েছে, তাতে অনেক প্রশ্নের জন্মও হয়েছে, যে গুলোর উত্তর দেওয়া যুক্তিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সম্ভব হয় না। কিন্তু পুরাণ কাহিনী মতে, কোনো দেব-দেবীর জন্মই বায়োলজিক্যাল নিয়মে হয়নি এটা সত্য বৈকি। দেব-দেবীদের বাহন হিসেবে যাদের বলা হয়, তারা-বিজ্ঞানের বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে সভ্য মানুষ সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই আছে। অত:পর দেব-দেবীদের সাথে থাকা এক একটি প্রাণী-এক একটি প্রতীক মাত্র। যা মানুষকে শিক্ষা দেয় অনেক কিছু। এ নিয়ে একটু পরেই আলোচনসায় আসবো। সিংহের পর, দুর্গার কাঠামোতে নজরে আসে মহিষ ও মহিষাসুরের। এটা অনেকেই জানেন, যে অসুরদেরকে হত্যা করার জন্য দুর্গার যুদ্ধ, সেই অসুরদের প্রধান নানা রূপ ধারণ করতে পারতো। সম্ভবত এই অসুরের একটি পছন্দের রূপ ছিলো মহিষ। একটি বাঘ বা সিংহের চেয়ে একটি মহিষের শক্তি অনেক বেশি, অসুরের এই রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতাকে বোঝানোর জন্যই দুর্গার কাঠামোয় ব্যবহার করা হয় মহিষ এবং এই মহিষের নাম অনুসারেই ঐ অসুরের নাম মহিষাসুর।
দুর্গাপূঁজার জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো, তবে-শিব, গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী, নবপত্রিকাসহ আরও নানা কিছু, এর কারণ কী? কারণ হলো : দুর্গাপূঁজা একটি মহাশক্তি ও মহামিলনের পূঁজা। সে কারণেই এই পূঁজায় সকল শক্তির মিলন ঘটানো হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, দুর্গা ছাড়া, দুর্গার সাথেই পূজিত অন্য সকল দেব-দেবীর পূঁজা বছরের বিভিন্ন সময় করা হয়। এই যেমন- দুর্গা পূঁজার রেশ না ফুরাতেই লক্ষ্মী পূঁজা, তার কয় দিন পর দুর্গারই আরেক রূপ কালী পূঁজা, তার কয়দিন পর কার্তিক পূঁজা, কিছু দিন পর সরস্বতী পূঁজা, এরপর গণেশ পূঁজা। তারপরও দুর্গাপূঁজার সময় আবার এই সকল দেব-দেবীকে একত্রিত করা হয় মূলত দুর্গাপূঁজাকে একটা ব্যাপকতা দেওয়া এবং সকল শক্তির সম্বন্বয়ে একটি মহাশক্তির পূঁজায় পরিণত করার উদ্দশ্যে। দুর্গার কাঠামোয় আর একটি রহস্যময় ব্যাপার হলো নবপত্রিকা।
দুর্গাপুজার প্রথম দিন অর্থাৎ সপ্তমীর দিন সকালে পুরোহিত অমৃতযোগ বা মাহেন্দ্রযোগে নবপত্রিকা নিয়ে নিকটস্থ কোন নদী বা পুকুরে তাঁকে স্নান করাতে নিয়ে যান। সঙ্গে পূঁজারী নারীরা শঙ্খধ্বন্নি ও উলুধ্বনি করতে করতে যান ৷ শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয় ৷ পরে তাকে মন্ডপে নিয়ে এসে মা দূর্গা এবং শ্রীগনেশের ডান পাশে রাখা হয় এবং মা দুর্গার সাথে চারদিন ধরে তার পূঁজো করা হয় ৷ নবপত্রিকা মন্ডপে প্রবেশের পূর্বে দেবী চামুন্ডার আবাহন পূঁজো করা হয় ৷ পত্রিকাস্থ অন্য কোন দেবীর পূঁজো করা হয় না ৷ প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ। আর আমরা তা না জেনে- এটাকেই মনে করে থাকি গনেশের বউ। আর পত্রিকা মানে পাতা হলেও আসলে নবপত্রিকা হলো নয়টি গাছ। এগুলি হল-১) কলা গাছ–ব্রহ্মানী, ২) কচু গাছ –দেবী কালিকা, ৩) হলুদ গাছ–দেবী উমা, ৪) জয়ন্তী গাছ– দেবী কার্ত্তিকী, ৫) বিল্বগাছ–দেবী শিবা , ৬) দাড়িম গাছ—দেবী রক্ত দন্তিকা, ৭) অশোক গাছ–দেবী শোকরহিতা, ৮) মান গাছ–দেবী চামুন্ডা, ৯) ধানগাছ–দেবী লক্ষ্মী ৷
আবার আমরা অনেকেই মনে করি, লক্ষ্মী-সরস্বতী দুর্গার মেয়ে, এই ভাবনার কারণ হলো, কার্তিক গনেশ লক্ষ্মী সরস্বতীসহ দুর্গা দেবীর পূঁজা শুরু হয় কোলকাতায় ১৬১০ সালে। দুর্গার সাথে একই কাঠামোয় কার্তিক গনেশ লক্ষ্মী সরস্বতীকে দেখে খুব সহজেই একটি পরিবারের চিন্তা মাথায় এসে যায়। সেই ভাবনা থেকেই আমরা মনে করে আসছি, লক্ষ্মী সরস্বতী দুর্গা দেবীর মেয়ে। সঠিক তথ্য না জেনে সেই ভুল বিশ্বাসকেই আমরা শত শত বছর ধরে সঞ্চারিত করে এসেছি এবং এখনো করছি আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে। কিন্তু আসলে তা নয়। দেবীদের উৎপত্তির ইতিহাসে লক্ষ্মী-সরস্বতী দুর্গার বড়, যদিও তারা তিনজনই একই পদমর্যাদার দেবী, কারণ- সরস্বতী, লক্ষ্মী ও দুর্গা যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের নারীশক্তি।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এক সাথে এতগুলো দেব-দেবীর পূঁজা করার দরকার কি ? প্রথমে দুর্গা পূজা যখন শুরু হয়, তখন শুধু দুর্গাকেই পূঁজা করা হতো এবং দুর্গার সাথে থাকতো মহিষ ও অসুর। দুর্গাদেবীর প্রাচীন যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে, সেগুলোতে এর প্রমান আছে। ১৬০০ সালের পর যেসব দুর্গাপূজা শুরু হয়, সেগুলো শুরু হয় রাজা-জমিদারদের মাধ্যমে। রাজা-জমিদাররা চাইতো, কয়েকদিন ব্যাপী বিরাট একটি জমজমাট উৎসব। কারণ তাদের টাকার কোনো কমতি ছিলো না, এক্ষেত্রে মূর্তি যত বড় ও বেশি হতো উৎসবও তত জমজমাট ও মানানসই হতো। ফলে চারদিকে এক ধরণের সাজ সাজ রব পড়ে যেতো। কিন্তু এর সাথে আধ্যাত্মিক কারণও আস্তে আস্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নির্জলা একাদশীর উপবাস নামে হিন্দু শাস্ত্রে উপবাসের বিধান আছে। যার একটা অন্যতম কারণ হলো: সারা বছরের উপবাসগুলো পালন করতে গিয়ে যদি নিজের অজ্ঞাতেই কোনো ভুল ত্রুটি হয়ে যায়, তাহলে নির্জলা উপবাস করলে তার পাপ মোচন হয়ে যায়। সারা বছর সকল দেব-দেবীর পূঁজা করা হলেও-দেবী রদুর্গা সাথে যদি তাদের আবারও পূঁজা করা হয়, তাহলে দেব-দেবীর একক পূঁজায় যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে তার সেই পাপ, দেবতারা সকলেই একত্রে ক্ষমা করবেন বলে বিশ্বাস করা হতো। এছাড়াও বহু দেবতার পূঁজা একসঙ্গে করার আরো একটি আধ্যাত্মিক কারণ হলো: শক্তির দেবী দুর্গা পূঁজাকে একটি মহাশক্তির পূঁজায় পরিণত করা। দূর্গাপূঁজায় রয়েছে সকল দেবতার প্রতিনিধি এবং শিব তো আছেই। শিবের প্রতিনিধি হিসেবে আছে স্বয়ং দুর্গা, ব্রহ্মার প্রতিনিধি হিসেবে আছে সরস্বতী, বিষ্ণুর প্রতিনিধি হিসেবে আছে লক্ষ্মী, আছে গণেশ যিনি সকল কাজের সিদ্ধিদাতা, আছে কার্তিক-যিনি যোদ্ধার প্রতীক, প্রকৃতির সকল গাছপালার প্রতিনিধি হিসেবে আছে নবপত্রিকা, প্রাণী জগতের প্রতিনিধি হিসেবে আছে-সাপ, সিংহ, মহিষ, ময়ূর, ইঁদুর, পেঁচা, হাঁস। এইভাবে দেবলোক এবং প্রাণী ও প্রকৃতি জগতের সকল কিছুর সমন্বয়ে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে এক মহামিলনের মহাশক্তির পূঁজা।
এবার আসা যাক, দুর্গাপূজার অন্যান্য বিষয়গুলোতে। মহালয়া কি ? মহালয়া হলো সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিন। কিন্তু তিথির ফেরে ২ বছর পরপর কার্তিক মাসের প্রথমে গিয়ে পড়তে পারে, যে বছর দুর্গাপূঁজা কার্তিক মাসে হয়। যে বছর দুর্গাপূঁজা কার্তিক মাসে হয়, তার পরের বছর মলমাস হিসেবে ৩০ দিন পুরো হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দুর্গাপূঁজাকে আবার আশ্বিন মাসের প্রথমে আনা হয়। একারণেই চন্দ্র ও তিথির হিসেব অনুযায়ী হিন্দু ধর্মের সকল পূঁজা পার্বন অনুষ্ঠিত হলেও কোনো অনুষ্ঠানের তারিখই একমাসের বেশি হেরফের হয় না।
যাই হোক, মহালয়া মানে আমরা জানি, ভোর বেলা রেডিও বা টিভিতে একটি অনুষ্ঠান যাতে দেবী দুর্গার কাহিনীসহ চন্ডীপাঠ করা হয়। আমরা হয়তো এটা অনেকেই জানি না যে, প্রকৃতপক্ষে মহালয়া থেকেই দুর্গাপূঁজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু। মহালয়া তিথির আরেক নাম পিতৃপক্ষ। হিন্দু ধর্মীয় মতে, এই তিথিতে সকল মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীতে নেমে আসে। তাদের এই নেমে আসাকে বলা হয়-মহালয়, আর সেই মহালয় থেকেই মহালয়া। এদিন সকালে পূর্বপুরুষদের আত্মার সদগতি ও সন্তুষ্টির জন্য নদীতে স্নান করে পূর্বপুরুষদেরকে স্মরণে নদীর জলেই অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। মহালয়ার তিথি শেষে শুরু হয় দেবীপক্ষ, যা চলে পূর্ণিমা পর্যন্ত। এই দেবীপক্ষেরই সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে দুর্গাপূঁজার মূল অনুষ্ঠান।
দুর্গাপূঁজার প্রধান অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হলো কুমারী পূঁজা। অষ্টমী তিথিতে এই পূঁজায় দুর্গাকে কুমারী হিসেবে পূঁজা করা হয়। কারণ, সকলের দুর্গতি নাশকারী আশ্রয়দাত্রী হিসেবে দুর্গাকে মা বলা হলেও দুর্গা আসলে কুমারী। স্থুল দৃষ্টিতে দুর্গাকে শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হলেও আসলে দুর্গা শিবস্থিত নারীশক্তি। যার কোনো আলাদা সত্ত্বা নেই। কিন্তু দুর্গা দেবীকে আলাদা সত্ত্বা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ফলে নারী জাতির একান্ত চাওয়া পুত্রের শখ পূরণ করতে দুর্গার একটি পুত্র গণেশের কল্পনা করা হয়। পুরাণ মতে, যাকে দুর্গাদেবী নিজেই সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে এক অসুরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার পরিকল্পনায়-শিব, দুর্গাকে অপর এক পুত্র কার্তিককে সন্তানরুপে দেন। মূলত দুর্গাদেবীর এই দুই পুত্রলাভ বায়োলজিক্যাল জন্ম নয়। যে কারণে দুর্গাদেবী কুমারী। আর এ কারনেই দুর্গাদেবীকে কুমারী রূপে পূঁজা করা হয়। তাছাড়া দুর্গাদেবীর যুদ্ধকালীন রূপ, যে রূপকে আমরা পূঁজা করি, দুর্গাদেবীর সেই রূপ যে কুমারী তার প্রমান আছে শুম্ভ নিশুম্ভের কাহিনীতে। যেমন- অসুর নিধনের উদ্দেশ্যে দুর্গাদেবীর আবির্ভাবের পর-তাকে দেখে শুম্ভ নিশুম্ভের “চর” শুম্ভ নিশুম্ভকে গিয়ে বলে এমন নারী আপনাদেরই যোগ্য, যিনি এখনো কুমারী এবং রুপবতী। এই কথা শুনে শুম্ভ নিশুম্ভ তাদের অন্য এক অসুর সুগ্রীবকে দুর্গাদেবীর কাছে পাঠায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। কিন্তু দুর্গাদেবী সুগ্রীবকে বলে, “আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি, যে আমাকে যুদ্ধে হারাতে পারবে-তাকেই আমি বিয়ে করবো। তোমার প্রভুকে গিয়ে বলো, আমার সাথে যুদ্ধ করতে।” এরপরই শুম্ভ নিশুম্ভ দুর্গার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করেন। যুদ্ধের আগে দুর্গাদেবী যদি নিজেকে কুমারী হিসেবে বিবেচনা না করতেন, তাহলে কিন্তু এই কথাটি দূর্গাদেবী এভাবে বলতে পারতেন না। যাই হোক, এই কুমারী পূঁজার মাধ্যমে পরিবারে কুমারী মেয়েদের সম্মানের বিষয়টি যেমন তুলে ধরা হয়েছে, সেই সাথে দুর্গাদেবীর মতো হাতে অস্ত্র ধরলেই যে তারা কেবল অসুর রূপী মানুষদের থেকে নিজেদের সম্মান ও কুমারীত্বকে রক্ষা করতে পারবেন, সেই বার্তাটিও মেয়েদের দেওয়া হয়েছে।
দুর্গাপূঁজার আরেকটি প্রধান বিষয় হলো সন্ধি পূঁজা। সন্ধি পূঁজা আসলে কি এবং কেনো এর নাম সন্ধি পূঁজা, সেই ধারণা সম্ভবত অনেকেরই জানা নেই। শুধু দুর্গাপূঁজা নয়, সনাতন বা হিন্দু ধর্মের সকল অনুষ্ঠানই তিথি নির্ভর। আমরা জানি, সন্ধি শব্দের অর্থ মিলন। অষ্টমী এবং নবমী তিথির সন্ধিস্থলে এই পূঁজা হয় বলেই এর নাম সন্ধি পূঁজা। সন্ধি পূঁজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। প্রথম ২৪ মিনিট অষ্টমী তিথির এবং পরের ২৪ মিনিট নবমী তিথির। এই পূঁজায় দুর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূঁজা করা হয়। যেটা কালীর সমগোত্রীয় দুর্গার আরেক রূপ। এই সন্ধি পূঁজা করা হয় ১৬টি উপাচার বা উপাদান দিয়ে। যার মধ্যে পশুবলির রক্ত ও মাংস দেয়ার বিধানও রয়েছে।
প্রচলিত ভাষায় দেব-দেবীদের বাহনের দিকে। আগেই বলেছি দেব-দেবীদের বাহনের কোনো প্রয়োজন নেই, দেব-দেবীদের সাথে তাদের রাখার কারণ হচ্ছে, তারা প্রকাশ করে ঐ দেব-দেবী বা তাদের পূঁজা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য। যা জানলে মানুষের অনেক উপকার হয়। উপরেই উল্লেখ করেছি, সিংহ হলো দুর্গার ক্রোধ ও ক্ষিপ্রতার প্রতীক। সিংহ এই তথ্য দেয়-দুর্গা অসুরদের সাথে কী ভয়ংকর ধরণের যুদ্ধ করেছে। তাছাড়াও যে কোনো যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে সিংহের মতো শক্তি, রাগ ও ক্ষিপ্রতার দরকার, সিংহ সেই তথ্যটিও আমাদেরকে দেয় অনায়াসে।
সাধারণ ভাবে বলা হয়ে থাকে, হিমালয় পর্বত দুর্গাকে দিয়েছিলো সিংহ। এসব ছেলে ভুলানো গল্প। আগেই বলেছি, পুরাণের গল্পগুলি শুধুই গল্প, বাস্তবতার সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। হিমালয় তো শুধু একটা পর্বত, এটা কিভাবে কাউকে কিছু দান করতে পারে ? মূল বিষয়গুলোকে উপলবদ্ধি করতে না পেরে “পুরান” রচয়িতারা বিষয়গুলোরে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য একটি করে গল্প তৈরি করে রেখে গেছেন। যা আজকাল সনাতন বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পালন করছে।
অন্যদিকে, গনেশকে বিশ্বাস করা হয় সিদ্ধিদাতা হিসেবে এবং গনেশের সাথে আছে ইঁদুর। পৃথিবীর এমন কোনো সফল ব্যক্তি নেই, যাকে নানা রকম বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যেতে হয় না। সাফল্যের পথে বাধা বিপত্তি একটা সাধারণ ব্যাপার, সেটা মানুষ মনের জোরে দূর করতে পারে, কিন্তু কারো সাফল্যের পথে যদি ষড়যন্ত্রের জাল থাকে, তাহলে তার পক্ষে সাফল্য লাভ করা শুধু অসম্ভবই না, এই ষড়যন্ত্র তাকে ধ্বংস করেও ফেলতে পারে। গনেশের সাথে ইঁদুর-মানুষকে একটি বার্তা দেয়, সাফল্যের পথে যে কোন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং যত ষড়যন্ত্রই হোক, সাফল্য পেতে চাইলে-সেই ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, ঠিক ইঁদুরের মতো। কারণ, জাল দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণীকে আটকানো গেলেও ইঁদুরকে কেউ আটকাতে পারে না, ইঁদুর জালকে কেটে বের হয়ে আসতে পারে।
কার্তিকের সাথে ময়ূর এবং ময়ূরের পায়ের তলে একটি সাপ। কার্তিক হলো যুবক, একজন যোদ্ধা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। ময়ূর-কার্তিকের এই তিনটি গুণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। মৃত্যু পর্যন্ত ময়ূরের সৌন্দর্য ও তারুণ্য নষ্ট হয় না। এছাড়া ময়ূর সকল পাখির মধ্যে ভয়ংকর যোদ্ধা এবং পাখিদের সম্রাট। সাপ হলো গোপন ষড়যন্ত্রের প্রতীক। যে কোনো যুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র থাকবেই। ময়ূরের পায়ের নিচে সাপের অর্থ হলো, শুধু যুদ্ধ করলেই হবে না, যুদ্ধের গোপন ষড়যন্ত্রকেও এইভাবে দমন করতে হবে, যেমন ময়ূর নিমিষের মধ্যে একটি সাপকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে পারে।
সরস্বতীর সাথে থাকা রাজহাঁসের ক্ষমতা। দুধ ও জল মিশিয়ে দিলেও সে শুধু দুধকেই পান করতে পারে বা গ্রহন করতে পারে। বিদ্যার দেবী সরস্বতী, তার রাজহংসের মাধ্যমে সমাজে-বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বার্তা প্রদান করেন, সমাজে ভালো মন্দ সব ধরণের জ্ঞানই আছে, তার মধ্য থেকে শুধু ভালোটাই গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও সরস্বতীর হাতের পুস্তক পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞানর্জনের কথা বলে সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপর সরস্বতীর হাতের বীণা বলে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কথা, শিল্প সাধনা মানুষকে সাধারণ থেকে অসাধারণ এবং মানবতার মাপকাঠিকে এক উচ্চ মাত্রায় মানুষকে মহান করে তুলে।
লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা-রাতের কঠিন অন্ধকারেও দেখতে পায় পেঁচা। অন্ধকার হলো বিপদ আপদের প্রতীক। ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর সাথে পেঁচা আমাদেরকে জানান দেয়, যদি টাকা পয়সা থাকে-তাহলে বিপদ আপদ যত বড় আর কঠিন হোক না কেনো, রাতের অন্ধকার ভেদ করে পেঁচা যেমন তার পথ দেখতে পায়, ঠিক তেমনি ধন-সম্পদের জোরে বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি পথ খুঁজে পাবে এবং তা থেকে উদ্ধার হবে। এ জন্যই সনাতন বা হিন্দু শাস্ত্রে দারিদ্রতাকে মহাপাপ বলা হয়েছে। কারণ: যে ব্যক্তি দরিদ্র অর্থাৎ অর্থ বিত্তহীন, তার সামনে সবই অন্ধকার। পেঁচার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো গোপনীয়তা। কেননা, সে গোপন থাকার কারণেই দিনের বেলা বের হয় না। লক্ষ্মীর সাথে পেঁচা মানুষকে এই বার্তা দেয়, অর্জিত ধন-সম্পদকে ধরে রাখতে হবে গোপনে, তা না হলে সেই ধন-সম্পদ বা অর্থ নানা বিপত্তির সৃষ্টি করতে পারে, তখন অর্থ হয়ে যাবে অনর্থ। এ জন্যই প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে অর্থই অনর্থের মূল।

আমাদের সাথেই থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই জাতীয় আরো খবর

Categories