রাজধানী ঢাকার পাশ্ববর্তী ইতিহাস এতিহ্যের ধারক-বাহক গাজীপুরের রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই আলাদা গুরুত্ব বহন করে আসছে যুগ-যুগান্তর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি এবং ক্ষমতাসীন সরকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের “গাজীপুর মহানগর” কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন কি স্থানীয় সিনিয়র নেতাদের নিয়ে কটূক্তিসহ বিভিন্ন প্রতিহিংশ্বামূলক সমালোচনা করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে স্যোশাল মিডিয়ায়। একটি ঘরোয়া আয়োজনে এই কটূক্তি এবং প্রতিহিংশ্বামূলক সমালোচনা’র ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কুটুক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তিক্ততা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল, মেয়রকে অবাঞ্চিত ঘোষনার দাবী, কুশপুত্তুলিকা দাহ, দলীয় পদ থেকে বহিস্কারের দাবীতে ফুসে উঠেছে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগসহ দলীয় অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। মেয়রের কান্ড-ঞ্জানহীন এমন এঘটনায় জেরে প্রতিদিনই চলছে প্রতিবাদসভা, মিছিল, ক্ষোভ-বিক্ষোভ।
এতে করে গাজীপুর মহানগরবাসী মনে করছেন, একজন রাজনৈতিক নেতার এহেন কর্মকান্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে এ অঞ্চলের উন্নয়ন ধারা। সরকারী তহবিলসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা কর্তৃক সিটি কর্পোরেশন উন্নয়নে যে বাজেট বরাদ্ধ করা হয়েছে, কিংবা রাস্তা-ঘাট, ড্রেন-কার্লবাট, বর্জ্য ও পয়:নিস্কাশন উন্নয়নে যে বৃহৎ কর্মজজ্ঞ চলছে সেগুলো গতি কমে গেলে চরম দূর্ভোগের শিকার হতে হবে বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ব্যবসায়ীসহ এ অঞ্চলের সর্ব সাধারণকে। এ দায়-ভার কে নেবে ?
ভিডিওতে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম-মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। অভিযুক্ত করেছেন স্থানীয় প্রবীন রাজনীতিবিদদের। নিজেকে তিনি সবার উর্দ্ধে স্থান দিয়ে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি নিজেকে সু-প্রতিষ্টিত ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে অর্থ-সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন। এ নিয়েও গাজীপুর মহানগরের আলোচনার ঝড় বইছে। ইতিমধ্যে দলীয় নেতাদেও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মেয়র এত অর্থ সম্পদের মালিক হলেন কি করে ? জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী বা প্রবীন নেতাদের নিয়ে মেয়রের কটাক্ষ বা এত দম্ভের উৎস কি ?
তবে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের দাবী, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। ভিডিও কারসাজি করা। ভিডিতে যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলো এডিট করা। তিনি এ ব্যাপারে মামলা করবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া চার মিনিটের ওই ভিডিওতে লক্ষ্য করা যায়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল প্রসঙ্গে অভিযযোগ ও বিরুপ সমালোচনা, হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবু নগরীর সাথে মেয়রের গভীর সখ্যতা ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করছেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। দেশের সর্ব বৃহৎ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশের মেয়র জাহাঙ্গীর দম্ভাক্তি আর বিভিন্ন মন্তব্যে মহানগর আওয়ামীলীগের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা পড়েছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
এদিকে, মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অনুসারীরা বলছেন, গত তিন বছরে গাজীপুরে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল মেয়রকে বিতর্কিত করতে এমন বক্তব্য প্রচার করছে।
এদিকে, টঙ্গীর একজন আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতা বলেন, জাহাঙ্গীর আলম মেয়র হওয়ার পর থেকেই বেপোরোয়া ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীরা আওয়ামীলীগে অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। আওয়ামীলীগের কেউ এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মামলা হামলার শিকারও হয়েছেন অনেকে। তিনি (মেয়র) আওয়ামীলীগের আদর্শকে মুখে ধারণ করলেও কাজ করছেন তার উল্টো। সারাদেশে হেফাজত যখন তান্ডব চালিয়েছিল, তখন গোপনে মেয়র জাহাঙ্গীর হেফাজতের নেতাদের অর্থ দিয়েও সহায়তা করেছিলেন, এমন অভিযোগও করেছেন ওই নেতা।
অপরদিকে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ভিডিওটির শুরতে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ বলেন, পাকিস্তন ভাঙার পেছনে রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনায় কাজ করেছে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি থাকত এখানকার মানুষ।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের প্রসঙ্গ টেনে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে বলতে শোনা যায়, আমি রাসেল সাহেবকে এইখানে নিয়া ফালাইছি। আমি চাইছি রাসেল সাহেব ভুল করুক। আমি ইচ্ছা করেই চাইছি হেও মিছিলটাতে এটেন্ড করুক।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজমত উল্লাহ আমারে জীবনে মারার লাইগা লোক কন্টাক্ট করছে, সব করছে। এখন সে আমার কর্মী হইছে। …আমারে জিগায় কী করছ ? আমারে কয়দিন জিগাইছে কী করো, কেমনে সম্ভব ? হেও সব জানে না ! আমি তো খেলা জিতছি।
ভিডিওতে জাহাঙ্গীর বলেন, আমি মন্ত্রীরে নিয়া মাথা ঘামাই না। জাহিদ আহসান রাসেল আছে না ? তারে নিয়া আমি এক মিনিটও চিন্তা করি না। খালি জাস্ট শুইনা রাখো, বিশ্বাস করার দরকার নাই। আমি চিন্তা করলাম সে তো মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠই। দরকারটা কী আমার এখানে, পরিবর্তনে কী হইব ? এখানে পরিবর্তনের লাভ টা কার ?
গত তিন বছরেও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে প্যানেল মেয়র নির্বাচন করা হয়নি। এ বিষয়ে ভিডিওটিতে মেয়র বলেন, প্যানেল মেয়র দেই না। দিলে কী হইব ? আমারে কি কাউন্সিলররা মেয়র বানাইছে ? আমার কি মেয়র গিরি যাইব গা ? যেমন আমি এখানে প্যানেল মেয়র করি নাই।
রাসেল এমপি অনেক রে মেয়র বানাইয়া দিতেছে, অনেক রে কাউন্সিলর বানাইয়া দিতেছে। প্রধানমন্ত্রী আরেক জনরে ভারপ্রাপ্ত দিব ?
বাংলাদেশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তি তার নিকটাত্মীয় উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর বলেন, বাতাসটা আমার কাছে বইলা যায়।
বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এমনকি হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার কথাও বলেন মেয়র জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, আমি জামায়াতের সাথে চলি না ? বিএনপির সাথে চলি না ? অন্য পার্টি আছে না সবার সাথেই তো কথা বলি। এই যে আমার সাথে ঘণ্টা তিনেক আগেও বাবু নগরী (হেফাজতের প্রয়াত আমির) প্রায় ৪৭ মিনিট কথা বলছে। সে আসতে চায়। আমি কথা বলছি না ?
আমার ধীরাশ্রম, ঝাঝর, চান্দরা আছে ৮/১০ বিঘা, দিঘিরচালা আছে ১৬ বিঘা, তেলিপাড়াও আছে। আমার এখানে সাড়ে তিন’শ বিঘা জমি আছে। এই নির্বাচনের সময়েও দশ হাজার কোটি টাকা আনছি। ভিডিওটি’র কথোপকথনে ধারনা করা তা গত ডিসেম্বর মাসে করা হয়েছিলো। ওই সময়ে মেয়র জাহাঙ্গীর ডিসেম্বর মাসের নাম উল্লেখ করেন।
এসব বিষয়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম গনমাধ্যমকে বলেন, এই ভিডিও সম্পর্কে কিছু না জানা নেই।
তিনি বলেন, এগুলো সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। ভিডিওটি কারা বানাইল, কারা এডিট করল, কিছুই জানি না। আমার প্রত্যেকটি কথা জোড়া দেয়া। আমার কথা কেটে কেটে বিকৃতভাবে প্রকাশ করেছে।
মেয়র আরো বলেন, আমি যখন ভাওয়াল কলেজের ভিপি নির্বাচন করেছি, তখন থেকেই একটা মহল আমার বিরোধিতা করেছে। সেই বিরোধীরা উপজেলা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ আজও সক্রিয়। আমি মামলা করব।
অপরদিকে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ করার পরও এলাকায় নতুন নতুন রাস্তাঘাট, ড্রেন, কালবার্ট, পুরাতন রাস্তাঘাট ভেঙ্গে সংস্কার করতে গিয়ে শত শত মানুষের বাড়ি ঘর ভেঙ্গে দেয়া বা জমিজমা নগর উন্নয়নে নেয়া এবং সুনিদিষ্ট ক্ষতিপূরণ না দেয়া, হোল্ডিং টেক্স বৃদ্ধি, বিশুদ্ধ সাপ্লাই পানির অপ্রতুল্যতা, শহরের অলি-গলিতে রাস্তাঘাট ও ড্রেণ উন্নয়য়ে ধীরগতি, রাস্তায় ল্যাম্পপোষ্ট ব্যবস্থা না করা এবং দলে স্বাধীনতা বিরোধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া, এমনকি জাতির জনক বঙ্গ বন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করাসহ স্থানীয় প্রবীন নেতাদের বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ এনে তাদের হেয় করে সমালোচনা করায় গাজীপুর আওয়ামীলীগ পরিবারে যে ধামামা বাজতে শুরু করেছে তার সমাধান কি হবে, তা কারো বোধগম্য নয়। তবে দেশ ও জাতির গর্ভ, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রিয় সফর শেষে দেশে ফিরে আসার পরই, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী রাজনীতিতে কিছু যে একটা ঘটতে যাচ্ছে, তা কারো অজানা নয়।
তবে যাই ঘটুক না কেনো, আমরা চাই নগর উন্নয়ন। স্থানীয় রাজনৈতি দন্ধ আর দম্ভের কারণে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের চলমান উন্নয়ন ধারা যেন স্তিমিত না হয়ে পড়ে, চরম দূর্ভোগ বা ক্ষতির মূখে পড়ে যেন-কোন নাগরিককে ভোগান্তির শিকার হতে না হয়, সে প্রত্যাশা গাজীপুরবাসী সকলের।
Leave a Reply