বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেল খেটেছিলেন উল্লেখ করে সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এবং মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. সুরেশ রঞ্জন বসাক বলেছেন, বৃটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামল মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৪৮তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষ্যে সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আজ আমি কোন সুনির্দিষ্ট প্রথা অনুসরণ করব না। না লিখিত প্রবন্ধ, না প্রথাগত বক্তৃতা- কোনটাতেই যাবো না। আমি আপাত-সম্পর্কহীন কিছু তথ্য উপস্থাপন করে যাব। আশাকরি সেগুলোর আলোকে আমরা একটি অর্থের পরম্পরা তৈরি করে নিতে পারব।
এসময় তিনি একগুচ্ছ প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে কোন একক নেতার সর্বোচ্চ অবদান ছিল? পাকিস্তানের ৭০ এর নির্বাচনে কোন দল সর্বোচ্চ আসন লাভ করেছিল এবং তার অবিসংবাদিত নেতা কে ছিলেন? নির্বাচনোত্তর অচলাবস্থায় ইয়াহিয়া, ভুট্টোসহ সবাই কোন বাঙালি নেতার সাথে আলোচনায় বসেছিলেন? তখন ৭৫’র পরবর্তী নেতাদের অবস্থান কোন সারিতে ছিল? কোন বাঙালি নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিয়ানওয়ালি জেলে ভরে মুক্তিযুদ্ধকে সাবোটাজ করার চেষ্টা করা হয়েছিল? কোন নেতা খোঁড়া কবরের সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনে রাজি না হয়ে মৃত্যুবরণ করা শ্রেয় মনে করেছিলেন? কোন নেতা কোন ইতিহাসে এমন নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হয়েছেন? এমন ডিরেসিনেশনের শিকার হয়েছেন? ঝাড়ে বংশে নিহত হয়েছেন?
তিনি বলেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, রাস্তা-ঘাট, সেতু-পুল-কালভার্ট, মিল-কারখানা, গ্রাম জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে, সর্বশেষ কানাকড়িটিও পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য, এক কোটি শরণার্থী ভারত থেকে দেশে ফিরছে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে, হাতে হাতে অস্ত্র, সেগুলো ফেরত নিতে হবে, ভারতীয় সেনাদের প্রত্যাহার করাতে হবে, অকাল বন্যায় ফসল ভেসে গেছে, দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, মার্কিনি হস্তক্ষেপে চুক্তিবদ্ধ শস্য- বোঝাই জাহাজ ফিরে গেছে, জাসদ সর্বহারাদের নৈরাজ্য বেড়েছে, অজনপ্রিয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে দুষ্কৃতকারীদের দমনের চেষ্টা চলছে, পাকিস্তান- ফেরত বাঙালি সেনাকর্মকর্তারা অসন্তুষ্ট, মজুতদার ঘুষখোর কম্বলচোরেরা সক্রিয়, দেশগঠনের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে গেছে, বাংলাদেশের জন্ম যারা চায়নি- স্বদেশে বিদেশে তারা ষড়যন্ত্রে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্যাস্ট্রো, ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ নেতারা তাকে তার জীবন-ঝুঁকির কথা জানিয়ে সতর্ক করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কুটনৈতিক- প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন রাষ্ট্রীয় ও আন্ত:রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ বিশ্বের ক’জন নেতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, তার অর্জন কী খুব কম ছিল? তার অবদান কী খুব কম ছিল?
প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনাদের জানা আছে। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই বললেও চলে। তবে সবসময়ই স্বরণ রাখতে হবে।
এবার দুয়েকটা তুলনা, প্রতিতুলনার কথা বলেন ড. সুরেশ রঞ্জন বসাক। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু চার হাজার ৬৮২ দিন জেল খেটেছিলেন, বৃটিশ ও পাকিস্তানি জমানা মিলিয়ে। আর মহাত্মা গান্ধী জেল খেটেছিলেন দু’হাজর ৩৩৮ দিন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বৃটিশ ভারতে। এছাড়া নেলসন মেন্ডেলা জেলে কাটিয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ২৭ বছর। এ তুলনা কাউকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার জন্যে নয়। আমাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝার জন্যে মাত্র।
প্রেসিডেন্ট লিংকনকে একটি মাত্র গুলিতে হত্যা করা হয়েছিল। গান্ধীকে মারতে তিনটি গুলি করেছিল নাথুরাম গডসে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ১৮টি গুলি খরচ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। দাস-প্রথা বিলোপ করার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন আব্রাহাম লিংকন, দেশ স্বাধীন করে প্রাণ দিয়েছিলেন গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু। লিংকন হত্যার পর ওয়াল্ট হুইটম্যামের মতো দু’একজন কবি ছাড়া কেউ ‘লিলাক ইলেজি’ বা ‘ক্যাপ্টেন ও মাই ক্যাপ্টেন’ এর মতো কবিতা লিখে মহান নেতাকে শ্রদ্ধা জানাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর লিখা হয়েছে শত শত কবিতা। বিখ্যাত অবিখ্যাত প্রায় সব কবিই কবিতায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এই নেতার প্রতি। অজস্র বইয়ের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম।
এছাড়াও তিনি কিছু বিচ্ছিন্ন তথ্যও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। দ্য লন্ডন টাইমস সম্পাদকীয়ের শুরুতে লিখেছিল : ‘শেখ মুজিবকে এত মর্মান্তিকভাবে হত্যা করা হলে বাংলাদেশের স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের কোনো প্রয়োজন ছিল না।’ (If Sheikh Mujib is killed so tragically, there was no need to emerge Bangladesh as a free country.)
কিসিঞ্জারের ঘৃণিত লিস্ট। ওই লিস্টে যে-কজন বিদেশি নেতার নাম ছিল তারা হলেন: দক্ষিণ ভিয়েতনামের নগুয়েন ভ্যান থিউ, চিলির সালভাদর আলেন্দে এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান। প্রচলিত মতে, শেষোক্ত দু’জনের মৃত্যুর সাথে এই লিস্টের সংযোগ ছিল।
ক্রিস্টোফার হিচেন্স তার ২০০১ সালের বই ‘দ্য ট্রায়াল অফ কিসিঞ্জারে’ লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন কিসিঞ্জার।’ (Kissinger was responsible for the killing of thousands of people, including Sheikh Mujibur Rahman.)
লিস্টের সাথে মিলছে কি? কিসিঞ্জার কিন্তু এখনও বেঁচে আছেন ১০০ পার করে।
১৩ আগস্ট খন্দকার মুশতাক বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসায় গেলেন। সেদিন রাসেলকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, আব্বাজানের মতো তুমিও বড় হও। আদরটা কি একটু বেশি হয়ে গেল না?
১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কাকতালীয় মনে হচ্ছে? ওই দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট মেজর ফারুকেরও জন্মদিন ও বিয়ের দিন। ১২ তারিখের গল্ফ ক্লাবের অনুষ্ঠানে মেজর ফারুক মেজর রশিদকে জানালেন, ওই দিনটি তার পছন্দের। কিছু বোঝা গেল?
ক্যান্টনমেন্টে যখন আততায়ীরা প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, মার্কিন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার তখন ছয়জন দূতাবাস কর্মকর্তাসহ এক রুমে বসেছেন। সাথে মাহবুবুল আলম চাষী ও করিম। সামনে পানপাত্র। তারা চিয়ার্স করছিলেন।
এদিকে ভোর রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি আক্রান্ত। আর তাতে নিহত জনক বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকালে তার ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম সাক্ষ্য দিলেন, ‘চারিদিকে একটি বীভৎস অবস্থা। ঠিক সেই মুহূর্তে উপর থেকে চিৎকার শুরু করল, পাইছি পাইছি। এরপর বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনলাম, তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস? এর পরে ব্রাশ ফায়ার। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ আমরা আর শুনতে পাইনি।’
শুনবেন কী করে? সিঁড়িতে পড়ে আছে বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ দেহ। স্টেনগান, পিস্তল ও রিভলভারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার বুক।
এসময় তিনি কবি রফিক আজাদি’র রচিত ‘এই সিঁডি’ কবিতা থেকে বলেন,
এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে
বত্রিশ নম্বর থেকে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
শোকস্তব্ধ দেশ। মানুষ যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। বিশ্ব মিডিয়ায় পরের দিন বঙ্গবন্ধু হত্যা লিড নিউজ হল। আমাদের মিডিয়ায় সেন্সর নেমে এল। নক্ষত্রপতন হল নীরবে নি:শব্দে। বঙ্গবন্ধু রাতারাতি হয়ে গেলেন একটি নিষিদ্ধ নাম।
এবার বিশ্বনেতারা কে কীভাবে শ্রদ্ধা জানালেন তার দুয়েকটি নমুনা দেখা যাক।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের নির্যাতিত মানুষ তাদের একজন মহান নেতাকে হারাল।’ (The oppressed people of the world have lost a great leader of theirs in the death of Sheikh Mujib.)
ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুর খবরে আমি ভেঙে পড়েছি। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অসাধারণ বীরত্ব এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।’ (I’m broken by the news of Sheikh Mujib’s death. He was a great leader. His
extraordinary heroism has been a source of inspiration for the peoples of Asia and Africa.
ইয়াসের আরাফাত বলেছিলেন, আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব এবং কোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। (Uncompromising combative
leadership and tender heart were the hallmarks of Mujib’s character.)
১৫ আগস্টের পর চীন, সৌদি আরব ও সুদান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। মার্কিন ডিপ্লোমেট হেরাল্ড স্যান্ডার্স পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারে কাছে জানতে চাইলেন, তারা নতুন সরকারকে সহায়তা দিতে পারেন কি না। কিসিঞ্জার জানালেন, ‘আমি বলতে চাই তাদের চিনতে পেরে আমরা দারুণ অনুভব করছি।’ (I want to say we feel great to have recognised them.)
এবার দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে নিন।
বঙ্গবন্ধু নেই। আবার বঙ্গবন্ধু আছেন। তিনি না থেকে পারেন না। শেষে তিনি রাহাত খানের কবিতাংশ দিয়ে শেষ করেন। তিনি বলেন,
‘আপনি নেই বঙ্গবন্ধু,
কেউ থাকে না এই মরজগতে,
কিন্তু আমরা বহুকোটি মানুষ
আপনাকে খুব ভালোবাসি,
আমাদের একেকটা হৃদয়
হয়ে যায় সর্বাংশে বাংলাদেশ,
সেখানে আপনার স্থান
গভীর গভীরতম শ্রদ্ধায়।
বর্তমান প্রজন্মের কবি এবং সাংবাদিক মৃণাল চৌধুরী সৈকত তার কবিতায় লিখেছেন-
পিতা তোমার মুখটি যখন
দুই নয়নে ভাসে,
কাজল কালো চোখের জ্যোতি
মিট মিটিয়ে হাসে।
যতন করে রেখেছি তোমায়
ছোট্র হৃদয় জুঁড়ে,
নিখুঁত এ প্রেম-ভালোবাসার
মনটি নিলে কেঁড়ে।
তোমার জন্যই স্বাধীন মোরা
বাংলা মায়ের বুকে,
যুগ-যুগান্তর থাকবে স্বরণ
মোদের সুখে দুঃখে।
হাসি মাখা চন্দ্র বদন
দুই নয়নে ভাসে,
ধানমন্ডির ওই সিঁড়ির কোনে
আছো তুমি বসে।
হাজার তারার ভীঁড়ে আজো
তোমায় খুঁজে বেড়াই,
এইতো বুঝি এলে ফিরে
আশায় দিন কাটাই।
তোমায় নিয়ে তর্ক করি
তুমিই জাতির পিতা,
তোমায় নিয়ে গর্ব করি
তুমিই বিশ্ব নেতা।
তোমার স্বপ পূর্ণ হলো
স্বাধীন সোনার বাংলায়
আমার স্বপ্ন তুমি পিতা
শুধু স্থৃতির মোহনায়।
Leave a Reply