টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় চার গুণ বন্দিদের দূর্ভোগ অন্ত নেই। খাদ্য-স্বাস্থ্য-যাতায়াত সর্বত্রই জনবল সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশে শিশু-কিশোর অপরাধীদের একমাত্র কারাগার টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র।
কেন্দ্রে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে চারগুণ বেশি বন্দি থাকা শিশু ও কিশোরদের চিকিৎসার জন্য নেই কোনো ডাক্তার বা নার্স। ফলে কোন বন্দি মারা গেলে প্রশ্নবিদ্ধ হয় এই প্রতিষ্ঠানটি । মৃত্যুর কারণ নিয়ে মৃতের পরিবারের অভিযোগ তো আছেই।
সরেজমিনে টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় অবস্থিত টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় এসব তথ্য।
টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান এই পদে কাজ করছেন ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে দীর্ঘ সময়। তিনি বললেন, চলতি বছর এই প্রতিষ্ঠানের মারা গেছে দুই বন্দি কিশোর। মাত্র ৫একর ৩৪ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বৃহৎ কেন্দ্রটি নানা সংকটে জর্জরিত হয়ে আছে শুধু জনবল, স্বাস্থ্য সেবা আর যানবাহন সংকটের কারণে।
তিনি আরো বলেন, একটি পাঁচতলা ও একটি দোতলা ভবনে থাকে শিশু-কিশোর বন্দিরা থাকে। এই বন্দিশালার ধারণ ক্ষমতা মাত্র ২০০ বন্দির। তবে অনুমোদন করা আছে ৩০০ বন্দি থাকার। অথচ এখানে আছে ৭২৭ জন বন্দি থাকে গাদাগাদি করে।
তত্ত্বাবধায়ক বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ আছে ৬৩টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৩১ জন। সিএসপিবি (চাইল্ড সেনসিবল প্রটেক্ট ইন বাংলাদেশ) প্রকল্পের আওতায় কর্মরত আছেন ৭ জন। প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তার জন্য ৫৫ জন আনসার সদস্য কাজ করছেন।
টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই । অথচ এখানে সরকারি অনুমোদিত পদ আছে দুটি, কজন নার্স ও একজন কম্পাউন্ডার। সেগুলো শুন্য। তবে সম্প্রতি জামালপুরে পদোন্নতি জনিত কারণে বদলি হওয়া একজন কম্পাউন্ডার প্রেষণে এখানে আছেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে। তিনিই বন্দিদের নামমাত্র চিকিৎসা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের জুন মাসে নয়ন নামে একজন ও ২৫ আগস্ট রাকিব নামে একজনসহ দুজন বন্দি কিশোর মারা যায়। তাদের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের অভিযোগ থাকলেও আমলে নেয়নি বা আসছে না। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো সক্ষমতা দরিদ্র অভিভাবকদের নেই।
টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে সব মিলিয়ে প্রায় ৮ শতাধিক লোকের যাতায়াতের জন্য একটি মাত্র মাইক্রোবাস রয়েছে। বন্দিসহ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এই একটি গাড়ি। টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আগুন লাগলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আগুন নেভানোর জন্য। সেক্ষেত্রেও নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাধী।
টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ধারণ ক্ষমতার চারগুণ বন্দির জন্য যেমন জরুরী আবাসন অবকাঠোমো , তেমনী জরুরি ডাক্তার, নার্সসহ পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতাল এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা।
অভিযোগ রয়েছ খাবার নিয়েও, জানা যায়, সকল বন্দির জন্য তিন বেলা খাবার রান্না করে খাওয়ানো হয়। তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি বিকেলে নাশতাও দেওয়া হয়। কিন্তু খাবারের মান একেবারেই নিন্মমানের। কর্তপক্ষ বলছেন, েলাকবলের অভাবে মাঝে মাছে একটু সমস্যা হয়। এতগুলো বন্দির জন্য বাবুর্চি রয়েছে মাত্র দুজন। তারাই এসব রান্না করে খাওয়ান।
প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়কের দেওয়া তথ্যমতে, বন্দি শিশুদের মানসিক বিকাশে ও সংশোধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা আছে। শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত। প্রশিক্ষণ ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন বেলা আড়াইটা থেকে ৩০ মিনিট করে প্রতি ফ্লোরের বন্দিদের পালাক্রমে মাঠে খেলতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফ্লোরের ভেতরে দাবা, কেরাম ও লুডু খেলার ব্যবস্থা আছে। প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক কাজ, অটোমোবাইলসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দিদের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাগেরহাট জেলার শরণখোলা থানার মালিয়া রাজাপুর গ্রামের সামুসল হক ভুইয়ার ছেলে মাহিনুর রহমান মুহিত (১৭) এই কেন্দ্রে বন্দি। গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকায় একটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র মুহিত। দুই মাস আগে একটি হত্যা মামলায় তার নাম আসে। ছেলে অপরাধ করেনি দাবি করে মুহিতের মা জানান, আমরা মুহিতকে থানায় নিয়ে গেছি। কারণ আমাদের ছেলে দোষী নয়। ২৯ আগস্ট আদালত মুহিতের জামিন দিয়েছেন। তাই নিতে এসেছি। কিন্তু এখানকার যা অবস্থা, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি থেকে কর্মকর্তারা পর্যন্ত দূর্নীতির আখড়া এই কিশোর উন্নয়ণ কেন্দ্র।
রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার ১৪ নম্বর আউটপুল এলাকার বাসিন্দা কশেম ও নাছিমা দম্পতি। তারা এসেছেন তাদের সন্তান নাঈমকে (১৪) নিতে। গত ৪১ দিন আগে একটি ডাকাতি প্রস্তুতি মামলায় গ্রেপ্তার হয় নাঈম। ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতের নির্দেশে টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আনা হয়েছে তাকে। গত রবিবার আদালত থেকে জামিন হলেও ছাড়া পাচ্ছে না নাঈম। আজ বুধবার পর্যন্ত ছেলের মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। জামিন হওয়ার পর কেন মুক্তি মিলছে না, সেই সম্পর্কে তারা বলেন, কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সময় লাগে বলে দেরী হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, এই প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব স্টাফ ও আনসার সদস্যরা পৃথক দুটি পক্ষ বেশ জোরালো ভাবে এবং প্রকাশ্যে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানের যেকোনো বন্দি থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন অফিস স্টাফরা। ফলে আনাসারদের সাথে অফিস স্টাফদের একটি ঠাণ্ডা লড়াই সব সময় লেগেই থাকে। কোনো বন্দি অসুস্থ হলে আনসার সদস্যরা স্টাফদের জানান। কিন্তু স্টাফরা বন্দির লোকজনের সাথে যোগাযোগ না হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন না। কোনো বন্দির বাসা থেকে খাবার ও অন্যান্য ব্যবহারিক জিনিসপত্র এলে বন্দিদের পর্যন্ত পৌঁছয় না আনসার বা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। বন্দিদের পরিবার যোগাযোগ করলে তবেই যায় ওইসব জিনিসপত্র।
এবিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান বলেন, এসব সত্য নয়। এটি একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। এখানে এমন করে কেউ ঠিকে থাকতে পারবে না।
সমাজসেবা অধিদপ্তর গাজীপুরের উপ-পরিচালক আনোয়ারুল করিম জানান, কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে কোনো অসুস্থ বন্দিকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাসেবা না দিয়ে অন্যত্র রেফার করা হয় শুধু। যদি হাসপাতালগুলো সাথে সাথে চিকিৎসার করত, তবে ভালো হতো। তিনি টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের আধুনিকায়নের প্রতি জোর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানান।
Leave a Reply